ভোলার চরে প্রভাবশালীদের দাপট
মূল ভূখণ্ড থেকে চরের দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। আশপাশের ইউনিয়নের প্রভাবশালীরা সেখানে নিয়ন্ত্রণ করেন।
নদীভাঙনের শিকার কয়েক হাজার মানুষের আশ্রয়স্থল এখন মেঘনা নদীর মাঝে জেগে ওঠা একটি চর। বাসিন্দারা এর নাম দিয়েছেন ‘ভোলার চর’। এই বাসিন্দারা চরটিতে স্থানীয় হয়ে উঠেছেন ১৫ থেকে ১৬ বছর ধরে। চরটিতে আসায় তাঁদের শুধু জায়গারই পরিবর্তন হয়েছে। নিত্যকার জীবনের দুর্ভোগ থেকে গেছে মূল ভূখণ্ডের মতোই।
চরে মানুষের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। ধারণার ভিত্তিতে স্থানীয় বাসিন্দারা এ তথ্য দিয়েছেন। জনসংখ্যার সঠিক হিসাব নেই প্রশাসনের কাছে। ভোলা সদর উপজেলার অন্তর্ভুক্ত চরটিতে রাজাপুর ইউনিয়ন থেকে ট্রলারে করে যেতে প্রায় এক ঘণ্টা লাগে। গত বৃহস্পতিবার ট্রলার চরে থামার পর নদীতে জেলেদের নৌকা আর মাঠজুড়ে চরে বেড়ানো গবাদিপশু জানান দিচ্ছিল, এসব ঘিরে চরের বাসিন্দাদের জীবিকা গড়ে উঠেছে। আছে চাষ করা ফসলের খেত।
সাধারণভাবে শান্তিপূর্ণ একটি জনবসতি মনে হলেও বিপরীতটা জানা গেল মানুষের সঙ্গে কথা বলে। ট্রলারে করেই মূল ভূখণ্ড থেকে প্রভাবশালী কিছু মানুষের যাতায়াত আছে এই চরে। তারাই এই চরের শাসন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন। জমির মালিকানা দাবি করে বাসিন্দাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন, না দিলে কেটে নিয়ে যান খেতের ফসল ও গবাদিপশু। মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে হওয়ায় চরটির বাসিন্দারা উপজেলা প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেও নালিশ দিতে পারেন না।
চরের বাসিন্দা মোফাজ্জল হোসেন বলছিলেন, রাজাপুর ইউনিয়নের ভাঙনকবলিত মানুষ ১৫ থেকে ১৬ বছর আগে চরে এসে হোগলাপাতা, খড়, বাজালি বন পরিষ্কার করে বসবাস শুরু করেন। ভাঙনের কারণে এ চর ভোলা থেকে অনেক দূরে। তবে বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ ও লক্ষ্মীপুরের কাছে। স্থানীয় জোতদার ছাড়াও পাশের দুই জেলার লোকজন মাঝেমধ্যে চরে হামলা চালিয়ে সম্পদ লুট করেন।
সরকারকে চরের জমির বাৎসরিক খাজনা দিতে হয় না। কিন্তু ভূমিদস্যুরা চরে বসবাসকারীদের কাছে থেকে বসবাস, ফসল উৎপাদন, গবাদিপশু পালনের জন্য বাৎসরিক চাঁদা নেয়। চাঁদা না দিলে ডাকাত দিয়ে হামলা, ঘরবাড়ি ভাঙচুর, খেতের ফসল, গবাদিপশু লুট করা হয়।
আরেক বাসিন্দা জসিম উদ্দিন বলেন, বছরে দুটি ফসল উৎপাদন হয়। ফসল উৎপাদনের সময়ই মূলত হামলার ঘটনা বেশি ঘটে। চরটি ভোলা, মেহেন্দিগঞ্জ নাকি লক্ষ্মীপুরের; তা নিয়ে মূল ভূখণ্ডের প্রভাবশালীদের মধ্যে বিরোধ আছে। সে বিরোধের জেরেও চরে এসে হামলার ঘটনা ঘটে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বাসিন্দা জানান, রাজাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাসেল খাঁ ও সাবেক ইউপি সদস্য ওহাব আলী চর নিয়ন্ত্রণ করেন। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে বিরোধ আছে। এসব বিরোধকে কেন্দ্র করে চরবাসী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। দিনে দিনে জমিতে ফসলের আবাদ যত বাড়ছে, তাঁদের সমর্থকদের হামলাও তত বাড়ছে। এ ছাড়া চরের জেলেরাও তাঁদের কাছে গলদা-বাগদা চিংড়ির রেণু বিক্রি করতে বাধ্য হন। মূল ভূখণ্ডে একটি রেণুর দাম পাঁচ টাকা হলেও চরে জেলেদের সে রেণু এক টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়।
মোতাহার মাতবর নামের এক বাসিন্দা বলেন, সরকারকে চরের জমির বাৎসরিক খাজনা দিতে হয় না। কিন্তু ভূমিদস্যুরা চরে বসবাসকারীদের কাছে থেকে বসবাস, ফসল উৎপাদন, গবাদিপশু পালনের জন্য বাৎসরিক চাঁদা নেয়। চাঁদা না দিলে ডাকাত দিয়ে হামলা, ঘরবাড়ি ভাঙচুর, খেতের ফসল, গবাদিপশু লুট করা হয়।
চরের জমি সরকারি। কয়েকজন মালিকানা দাবি করে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাচ্ছেন। কিন্তু চরটি তীর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে। যেতেও ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। তাই সেখানে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
অভিযোগের বিষয়ে রাসেল খাঁ বলেন, চরের কিছু জমি তাঁর ও আত্মীয়স্বজনের পৈতৃক। ওহাব আলী ও তাঁর সমর্থকেরা এসব জমি ভোগদখল করছেন। মালিকানা চাইতে গেলে তাঁদের হামলার শিকার হতে হয়। আর ওহাব আলী বলেন, রাসেল খাঁ আমন ধান ও রবি মৌসুমের শুরুতে চরের নিরীহ কৃষকদের ওপর হামলা চালান। স্থানীয় লোকজন তাঁদের বাধা দিতে গেলে ঘরে আগুন দেওয়া ও ভাঙচুর করা হয়। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেন রাসেল খাঁ।
ভোলার পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার বলেন, দীর্ঘদিন ধরে চর দখল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কয়েকটি পক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত। চরের বাসিন্দাদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করতে পুলিশ তদন্তকেন্দ্র বা পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের জন্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক বলেন, চরের জমি সরকারি। কয়েকজন মালিকানা দাবি করে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাচ্ছেন। কিন্তু চরটি তীর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে। যেতেও ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। তাই সেখানে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।