ভোলার ৭৪ চরে জোয়ারে কোমরপানি, সঙ্গে ভাঙন

জোয়ারের সঙ্গে লাগাতার ভাঙন, অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে দিশেহারা জেলার ছয়টি উপজেলার দেড় লাখ মানুষ।

জোয়ারের পানি নেমে গেলেও রেখে গেছে ছাপ। পানির তোড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাড়িঘর ও গাছপালা। সম্প্রতি ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামেছবি: প্রথম আলো

ঘূর্ণিঝড় সিডর তাণ্ডব চালিয়েছিল ১৪ বছর আগে। এরপর থেকে প্রতিবছরই ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতি গুনছেন ভোলার নিম্নাঞ্চলের মানুষ। গত বছর ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর থেকে উচ্চমাত্রার জোয়ার যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। জোয়ারের সঙ্গে লাগাতার ভাঙন, অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে দিশেহারা জেলার ছয়টি উপজেলার ৭৪টি চরের বাসিন্দারা।

জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, দেশের নদ-নদীর পানি ভোলার আশপাশ দিয়ে সাগরে নামে। ফলে এখানে নদীতে তীব্র স্রোত থাকে। সাগরে জোয়ার হলে নদ-নদী ফুঁসে ওঠে। জলোচ্ছ্বাসে নিমজ্জিত হয় ফসলি মাঠ ও বাড়িঘর। পানি নেমে গেলেও ক্ষতির রেশ কাটে না জোয়ারের সঙ্গে উঠে আসা লবণ-পানির কারণে। আবার নদীর ডুবোচরে ও চাঁদপুরের তীর-সংরক্ষণ বাঁধে নদীর স্রোত বাধাগ্রস্ত হয়। এর প্রভাবে লাগাতার তীব্র স্রোতের আঘাতে ভোলায় ভাঙন নিত্য ঘটনা।

প্রাকৃতিক এই দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত নয় ইউনিয়নের ৭৪টি চরের মানুষ। ইউনিয়ন পরিষদ সূত্র বলছে, এসব চরে দেড় লাখের মতো মানুষ বাস করে। এসব চরের মধ্যে রয়েছে চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর, কুকরি-মুকরি, চরপাতিলা, চর মুজিবনগর ও সিকদারের চর; লালমোহন উপজেলার চর-কচুয়া ও চর শাহাজালাল; মনপুরা উপজেলার কলাতলীর চর; ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর, ভেলুমিয়া ও ভেদুরিয়া; দৌলতখান উপজেলার মদনপুর, মেদুয়া, হাজিপুর ও ভবানীপুর এবং তজুমদ্দীন উপজেলার সোনাপুর, মলংচরা ও চর মোজাম্মেল।

জানতে চাইলে ভোলার জেলা প্রশাসক তৌফিক-ই-লাহী চৌধুরী বলেন, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগ থেকে রক্ষায় চরাঞ্চলের মানুষগুলোকে বাঁধের ভেতরে আনা দরকার। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ঘর উপহার দিয়ে অনেককে বাঁধের ভেতরে আনা হচ্ছে। তবু অনেকে দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় রয়েছেন। তাঁদেরও নিরাপদ স্থানে আনতে সরকার কাজ করছে।

সাগর মোহনায় অবস্থিত চরফ্যাশনের ঢালচর ইউনিয়ন। প্রতিরক্ষা বাঁধ না থাকায় ইউনিয়নটি নিয়মিতই জোয়ারে প্লাবিত হয়। উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকের ভাঙনে ইউনিয়নটির ৯০ শতাংশ গত ১০ বছরে বিলীন হয়েছে।

ঢালচরের মাছ ব্যবসায়ী শাহে আলম ফরাজী বলেন, সাগর একটু ফুঁসে উঠলেই প্রতিটি বাড়িতে পানি ওঠে। ঘর ছাড়া আশ্রয় নেওয়ার জায়গা নেই। ঘরের মাচায় পশুপাখি ও মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানিবন্দী থাকে। সাগর মোহনার এই সমৃদ্ধ মাছঘাট দিনে দিনে ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

গত ২৫ জুলাই দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, ভোলা সদরের রাজাপুর ইউনিয়নের রামদাসপুর, সুলতানি, রূপাপুর, দক্ষিণ রাজাপুর, কন্দ্রকপুর, মেদুয়া, দাইয়ার পাড় ও চর মোহাম্মদ আলী পানির নিচে। ফসলি জমিতে কোমরপানি। অনেকের ঘরেও পানি উঠেছে।

দক্ষিণ রাজাপুরের বাসিন্দা শাহে আলম রাঢ়ি (৭১) বলেন, এলাকাটা তীব্র ভাঙনকবলিত। ভাঙনের কারণে তাঁর তিন ফসলি জমি এক ফসলিতে পরিণত হয়েছে। শীতকালে কেবল শাকসবজির আবাদ করতে পেরেছেন। লবণ-পানি ওঠায় আউশের আবাদ করতে পারেননি। আমনের জন্য বীজতলা করেছিলেন; জোয়ারে ভেসে গেছে।

দৌলতখানের মদনপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য ফারুক দৌলত বলেন, ২০২০ সাল ছিল ঝড়-বৃষ্টির বছর। কৃষক বারবার বীজ ফেলেও ফসল ফলাতে পারেননি। চলতি বছরে টানা খরা দেখেছেন কৃষক। এর মধ্যে ৩০ মার্চ হঠাৎ আসে উঁচু জোয়ার। কয়েক হাজার একর ফসলি জমি ডুবে যায়। লবণ-পানিতে খেতের ফসল পচে যায়।

ভোলা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রিয়াজউদ্দিন বলেন, উঁচু জোয়ার, লবণাক্ততা ও খরা নিত্যসঙ্গী নিম্নাঞ্চলের মানুষের। বিষয়টি মাথায় রেখে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। আউশে এনেছে ব্রি-৭ হাইব্রিড জাত, যা হেক্টরে ৭ মেট্রিক টন ফলন দিচ্ছে। সব ধানের লবণসহিষ্ণু জাত দেওয়া হচ্ছে। সর্জান পদ্ধতিতে (একসঙ্গে সবজি ও মাছ চাষ) চাষাবাদে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলাকাবাসীর ভোগান্তি কমাতে পারে সঠিক উচ্চতার টেকসই বাঁধ। বাঁধের উচ্চতা হতে হবে ৮ মিটার; চূড়া হবে ৭ মিটার।

বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ফাউন্ডেশনের ‘জলবায়ু অর্থায়নে স্বচ্ছতা অর্জনে কৌশল’ প্রকল্পের প্রধান সৈয়দ আমিনুল হক বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলে যেভাবে বাঁধ হচ্ছে, তার মেয়াদ চার-পাঁচ বছর। এসব বাঁধ জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে যাচ্ছে। তাই টেকসই বাঁধ নির্মাণে ও ডুবোচর কেটে নদীর নাব্যতা ফেরাতে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন তাঁরা।

ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী হাসানুজ্জামান বলেন, চরাঞ্চলের বাঁধ নির্মাণের আগে ভাঙন প্রতিরোধ জরুরি। তা না হলে বাঁধ টেকসই হবে না। পাউবো টেকসই বাঁধ নির্মাণে গুরুত্ব দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাঁধের উচ্চতা বাড়ানো ও ব্লক দিয়ে বাঁধ মুড়িয়ে দেওয়া দরকার। এসব বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে।