মঙ্গল কামনায় ত্রিপুরাদের পাড়ায় পাড়ায় গড়াইয়া নাচ

বৈসু উপলক্ষে মঙ্গল কামনায় গড়াইয়া নাচ করছেন একদল তরুণ। আজ বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়ি সদরের পেরাছড়া ইউনিয়নের চন্দ্র কিরণ কার্বারি পাড়া থেকে তোলা
প্রথম আলো

দূর থেকে শোনা যাচ্ছে ঢোল, বাঁশি আর মাদলের শব্দ। পাড়ার কাছে যেতেই ১০-১৬ জনের একটি দল নাচের সঙ্গে গেয়ে যাচ্ছে ‘ফাইখালে, ফাইখালে, গড়াইয়া ফাইখালে’ (এসেছে এসেছে গড়াইয়া নাচের দল)। এসব গান আর নাচ চলছে এখন ত্রিপুরা পল্লিগুলোতে। বৈসুর অপরিহার্য অনুষঙ্গ গড়াইয়া নাচ। আজ বৃহস্পতিবার সকালে এই নাচের দুটি দলের দেখা মিলল খাগড়াছড়ি সদরের পেরাছড়া ইউনিয়নের চন্দ্র কিরণ কার্বারি পাড়ায় এবং পানছড়ি উপজেলার লোগাং এলাকায়।

লকডাউনের কারণে সীমিত পরিসরে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের লোকজন বৈসু পালন করছেন। তবে দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে রীতি অনুযায়ী শুধু মঙ্গল কামনায় কোনো কোনো এলাকায় গড়াইয়া নাচ করতে দেখা গেছে।

এক বাড়িতে নাচ শেষে বাঁশি আর ঢোল বাজাতে বাজাতে পাহাড়ের আরেক বাড়ির উঠানে গিয়ে হাজির হচ্ছেন তাঁরা। নাচ শেষে গৃহস্থ সামর্থ্য অনুযায়ী পানীয়, চাল, টাকা আর ফলমূল দিচ্ছিলেন তাঁদের।

খাগড়াছড়ি সদরের পেরাছড়া ইউনিয়নের চন্দ্র কিরণ কার্বারি পাড়ায় দেখা মিলল তেমনি গড়াইয়া নাচের একটি দল। পরনে একই রঙের জামা, মাথায় আর কোমরে রিচা নামক একধরনের লম্বা ঝুল বেঁধে দলের সদস্যরা গৃহস্থের উঠানে নাচ করছিলেন বিভিন্ন মুদ্রায়। এক বাড়িতে নাচ শেষে বাঁশি আর ঢোল বাজাতে বাজাতে পাহাড়ের আরেক বাড়ির উঠানে গিয়ে হাজির হচ্ছেন তাঁরা। নাচ শেষে গৃহস্থ সামর্থ্য অনুযায়ী পানীয়, চাল, টাকা আর ফলমূল দিচ্ছিলেন তাঁদের।

নাচের সদস্য রবিধন ত্রিপুরা বলেন, এ নাচে ২২টি তাল ও মুদ্রা রয়েছে। এ তালে মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব ক্রিয়াকলাপ প্রদর্শন হয়ে থাকে। ২২টি মুদ্রা প্রদর্শনের পর বাড়ির কর্তা ও কর্ত্রী বায়না করে থাকেন। বেশির ভাগ যুবক-যুবতীর প্রেম বিরহ, স্বামী-স্ত্রী ঝগড়া দেখতে চান। কেউ একবার গড়াইয়া নাচে অংশ নিলে তাঁকে পরপর তিন বছর নাচে অংশ নিতে হয়। যদি কোনো কারণে অংশ নিতে না পারে, তবে গড়াইয়া দেবতার কাছ থেকে ক্ষমা চাইতে হয়।

বৈসু উপলক্ষে মঙ্গল কামনায় গড়াইয়া নাচ করছেন একদল তরুণ। আজ বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়ি সদরের পেরাছড়া ইউনিয়নের চন্দ্র কিরণ কার্বারি পাড়া থেকে তোলা
প্রথম আলো

যেকোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের আগে গড়াইয়া নাচের প্রচলন আছে ত্রিপুরা সমাজে। একসময় যুদ্ধযাত্রার আগেও এ নাচ হতো। বর্ষবিদায় ও বরণের আগেও মঙ্গল কামনার উদ্দেশ্যে এই নাচ করা হয়।

পেড়াছড়া এলাকার গড়াইয়া নাচের সদস্য ধনমনি ত্রিপুরা বলেন, ‘করোনার আগে বৈসুর এক সপ্তাহ আগে থেকে বিভিন্ন পাড়ায় গিয়ে গড়াইয়া নাচ করতাম। এই বছর শুধু মঙ্গল কামনার জন্য পাড়ায় বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে নাচ করেছি।’

নববর্ষ অর্থাৎ ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বৈসু উৎসবের এক সপ্তাহ আগে থেকে শুরু হতো এ গড়াইয়া নাচ। ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, নাচের মধ্য দিয়ে তুষ্ট হন গড়াইয়া দেব। এতে পরিবার, এলাকাবাসীর ও সমাজের সুখ-সমৃদ্ধি অটুট থাকে।