মজুরিবৈষম্য কমছে না নারী শ্রমিকদের

গোলেজান বেগম ইট ভেঙে টুকরো টুকরো করেন। শরীরের ঘাম ঝরিয়ে টাকা আয় করেন। তা দিয়ে খাওয়া-পরা চলে তাঁর। বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। তবু এখনো গায়ে তাঁর বল আছে। দিনভর হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে পারেন। নিজের আয়রোজগারে পেটের ভাত জোটে। এটিই তাঁর বড় সান্ত্বনা। গতকাল দুপুরে বগুড়ার শাজাহানপুরের সুজাবাদ এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
গোলেজান বেগম ইট ভেঙে টুকরো টুকরো করেন। শরীরের ঘাম ঝরিয়ে টাকা আয় করেন। তা দিয়ে খাওয়া-পরা চলে তাঁর। বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। তবু এখনো গায়ে তাঁর বল আছে। দিনভর হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে পারেন। নিজের আয়রোজগারে পেটের ভাত জোটে। এটিই তাঁর বড় সান্ত্বনা। গতকাল দুপুরে বগুড়ার শাজাহানপুরের সুজাবাদ এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

বগুড়ায় ২৩২টি ইটভাটায় প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। তাঁদের প্রায় অর্ধেকই নারী। তবে তাঁরা সমানতালে কাজ করেও দিন শেষে পুরুষ শ্রমিকের অর্ধেক মজুরি পান।

জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয়ের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি ইটভাটায় প্রতি মৌসুমে গড়ে এক লাখ থেকে দেড় লাখ পর্যন্ত ইট প্রস্তুত হয়। এসব ইট বগুড়া ছাড়াও আশপাশের জেলায় ইমারত, সেতু-কালভার্ট ও রাস্তাঘাট নির্মাণকাজে ব্যবহার করা হয়।

শাজাহানপুর উপজেলার সুজাবাদ এলাকায় মেসার্স বদর উদ্দিন ইটভাটার মালিক ও মাঝিড়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আবু জাফর বলেন, প্রতিটি ইটভাটায় গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ জন শ্রমিক কাজ করেন। নারী শ্রমিকেরা সকাল-সন্ধ্যা কাজ করে গড়ে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা মজুরি পান। অন্যদিকে পুরুষ শ্রমিকেরা মজুরি পাচ্ছেন কাজের ধরনভেদে ৩০০ থেকে ৮০০ টাকা। নারীরা ভাটায় হালকা কাজ করেন, এ কারণে তুলনামূলক কম মজুরি পান। পুরুষেরা ভারী কাজ করেন। তাঁরা মজুরিও বেশি পান।

গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিনে শাজাহানপুর উপজেলার সুজাবাদ, বেজোড়া, চাঁচাইতারা, খোট্টাপাড়া, খলিসাকান্দি দুরুলিয়া এলাকায় বিভিন্ন ইটভাটায় দেখা গেছে, প্রতিটি ভাটায় ইট তৈরি ও পোড়ানোর কর্মযজ্ঞ চলছে। পুরুষ শ্রমিকের সঙ্গে নারীরা ইট তৈরি, পোড়ানো ইট সরানো ছাড়াও ইট ভাঙার কাজ করছেন। প্রতিটি ভাটায় ধুলাবালি আর ধোঁয়া উড়লেও শ্রমিকদের মুখে কোনো মাস্ক বা কাপড়ের আবরণ নেই।

শাজাহানপুর উপজেলার খোট্টাপাড়া এলাকায় মেসার্স শাহীন ব্রিকস (এনএসবি), এসটিবি, এআরএন ব্রিকস ফিল্ড, মেসার্স থ্রিস্টার ও টিএসবি ব্রিকস ফিল্ডে ১০-১২ জন শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয়। শাহিদা বেগম নামের একজন নারী শ্রমিক বলেন, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ইট সরানোর কাজ করে তিনি ২০০ টাকা মজুরি পান। এ টাকায় তাঁর তিন সদস্যের সংসার চলে।

আবদুল হক নামের একজন পুরুষ শ্রমিক বলেন, ইটভাটায় কাজ করে তিনি প্রতিদিন ৪০০ টাকা মজুরি পান।

একই চিত্র দেখা গেছে এলজিপি-১, এলজিপি-২, এলসিবি, এসএসবি, এসবিএফ, জেবিএফ ইটভাটায়। সেখানেও পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে সমানতালে কাজ করছেন নারীরা। মুখোশ নেই কারও মুখে।

সুজাবাদ এলাকার এবিএস ভাটার শ্রমিক সাহেরা বেগম স্বামী মারা যাওয়ার পর তিন সন্তান থাকলেও কেউ খোঁজ নেন না। অন্যের বাড়িতে থাকেন। ১০ বছর ধরে ইটভাটায় কাজ করছেন। তিনি দিনে ২০০ টাকা মজুরি পান।

 সুজাবাদ দহপাড়া গ্রামের কমেলা বেগম ইটভাঙার কাজ করেন। দিন শেষে ২৩০ টাকা মজুরি পান। তিনি বলেন, একই ইটভাটায় একই কাজ করে পুরুষ শ্রমিকেরা মজুরি পান ৮০০ টাকা।

 ফুলারা বেগমের দুই ছেলে আছেন। কিন্তু তাঁরা মায়ের খোঁজ নেন না। ছোট ছেলের পড়াশোনার খরচ জোগাতে ইটভাটায় কাজ করেন তিনি। বানানো ইট সরানোর কাজ করে দিনে ১৮০ টাকা মজুরি পান।

হালিমা বেগম গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর থেকে বগুড়ায় এসে ইটভাটায় কাজ নিয়েছেন। দিন শেষে তিনি ২০০ টাকা মজুরি পান। হালিমা বলেন, ইটভাটার ধুলাবালি-ধোঁয়ায় অ্যাজমা রোগে ভুগছেন। প্রায়ই অসুস্থ হচ্ছেন।

সুজাবাদ এলাকার একটি ইটভাটায় ইট ভেঙে খোয়া বিক্রি করা হচ্ছে। শ্রমিক মোর্শেদা বেগম ও রেহানা বেগম ইট ভাঙার কাজ করে দিনে ২০০ টাকা করে মজুরি পান। অন্যদিকে একই সঙ্গে কাজ করছেন শ্রমিক দুলাল প্রামাণিক। একই কাজ করে তিনি দৈনিক ৮০০ টাকা মজুরি পান।

 জানতে চাইলে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের বগুড়া কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক শাহ মোফাখখারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শ্রম আইন অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে সমকাজে সমমজুরি নিশ্চিত করতে হবে। ইটভাটায় নারী শ্রমিকেরা মজুরিবৈষম্যের শিকার হয়ে থাকলেও এত দিন আমাদের কাছে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। খোঁজখবর নিয়ে ইটভাটার মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’