মনে এখনো দুঃসহ স্মৃতি আর বিচারের অপেক্ষা

গত আট বছরে হতাহতদের পরিবারের খোঁজ নেয়নি কেউ। নির্দেশনা না থাকায় নিহতদের পরিবারের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করা হয়নি

হঠাৎ হইচই শুনে দৌড় দেন রিকতা খাতুন। ভবনের সিঁড়ি বেয়ে নামতে ধসে পড়া ছাদের নিচে চাপা পড়েন। ডান হাতের ওপর ইটের দেয়াল ভেঙে পড়ে। চার দিন পর করাত দিয়ে হাত কেটে তাঁকে বের করা হয়। দুই মাস ধরে চিকিৎসা নেওয়ার পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন।

রিকতার (৩১) বাড়ি গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার ফরিদপুর ইউনিয়নের চকগোবিন্দপুর গ্রামে। আট বছর আগে ঢাকার সাভারে রানা প্লাজা ভবন ধসে নিজের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বর্ণনা দিচ্ছিলেন গত মঙ্গলবার। বলছিলেন, স্বাবলম্বী এক নারীর হঠাৎ করেই পরনির্ভরশীল হওয়ার গল্প।

চকগোবিন্দপুর গ্রামে রিকতা এখন তাঁর দিনমজুর বাবার বাড়িতে থাকেন। ভবনধসের আগেই বিবাহবিচ্ছেদ হয় তাঁর। দুই সন্তান আছে। তাদের একজন কলেজে পড়ছে। এক হাত না থাকায় ঘরের টুকটাক কাজ ছাড়া ভারী কাজ করতে পারেন না। দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া ১২ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র আছে। এর সুদের টাকায় সংসারের খরচ চালাচ্ছেন। কিন্তু নিজে কিছু করতে না পারার আক্ষেপে পোড়েন এখনো। আক্ষেপ আছে ক্ষতির জন্য দায়ীদের বিচার না হওয়ারও।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে গাইবান্ধা জেলার ৪৯ জন নিহত, ১১ নিখোঁজ ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। আহতদের মধ্যে কেউ কেউ এখন কোনোরকমে জীবিকা নির্বাহ করছেন। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীর অনুদান হিসেবে তিন দফায় নিহতদের পরিবারকে ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। এরপর গত আট বছরে কোনো আর্থিক সহায়তা মেলেনি। চকগোবিন্দপুরের রিকতা খাতুনের দিন চললেও এখনো মানবেতর জীবনযাপন করছেন বেশ কয়েকজন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবারের স্বজনেরা।

ভবনধসে ডান পা হারান সাদুল্লাপুর উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ দামোদরপুর গ্রামের সোনিয়া বেগম (২৬)। ২০১১ সালে পূর্ব দামোদরপুর গ্রামের মিজানুর রহমানের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। দুই বছর পর দুজনে ঢাকায় যান ভাগ্য বদলের আশায়। রানা প্লাজার একটি পোশাক কারখানায় কাজ শুরুর ২২ দিনের মাথায় ভবনধসের ঘটনা ঘটে। মিজানুর অন্য কাজে বাইরে থাকায় বেঁচে যান। মিজানুর বলেন, ভেবেছিলেন দুজনের আয় দিয়ে সংসারে সচ্ছলতা ফিরবে, তা আর হয়নি। বর্তমানে বাড়িতেই ছোট দোকান দিয়েছিলেন। কিন্তু মূলধনের অভাবে সেটি এখন বন্ধ। ছয় বছরের শিশু মিম্মি ও মা–বাবাকে নিয়ে কোনোরকমে সংসার চলছে। ভবনধসের পর সরকার চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো তা পাননি তাঁরা।

সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের সাতগিরি গ্রামের লাভলী খাতুন (২৯) ভবনধসে বাঁ পা হারান। এখন ক্রাচে ভর দিয়ে চলাচল করেন। সম্প্রতি তাঁর বাড়িতে গেলে বলছিলেন, সংসার চলছে কোনোরকমে। কিন্তু পা হারিয়ে যে কষ্ট সহ্য করছেন তা বর্ণনা করার মতো নয়। আক্ষেপ হয়, পা হারানোর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার দেখতে না পাওয়ার।

নিহতদের পরিবারে দুর্দশা

ভবনধসে নিহতদের পরিবারের পুনর্বাসনের বিষয়ে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা এ কে এম ইদ্রিস আলী জানিয়েছেন, এ বিষয়ে এখনো কোনো সরকারি নির্দেশনা আসেনি।

সাদুল্লাপুরের কিশামত হলদিয়া গ্রামের স্মৃতি রানী (২৭) ভবন ধসে নিহত হন । বড় বোন মাধবী রানী বলেন, চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। চাকরি দূরের কথা, আট বছরে কেউ খোঁজও নেয়নি।