মহাপরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনা সাড়ে ছয় বছরেও অনুমোদন করেনি স্থানীয় সরকার বিভাগ। এ সুযোগে যত্রতত্র হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ নানা ধরনের স্থাপনা গড়ে উঠেছে। একসময়ের ছিমছাম শহরে এখন বহুতল ভবনের ছড়াছড়ি। নগর ভবনের প্রকৌশলীরা বলছেন, ২০ বছর মেয়াদি ওই মহাপরিকল্পনা ধরে এগোলে কুমিল্লা পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠত। নগরের চেহারা পাল্টে যেত।

জানতে চাইলে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম ৫ জুন রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহাপরিকল্পনা অনুমোদনের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে, আমাকে কেউ বলেনি। আমি তো প্রায় আড়াই বছর এই মন্ত্রণালয়ে আছি। আমাকে জানালে আমি সেটি দেখতাম। উল্টো আমি কুমিল্লা নগরীকে ঢেলে সাজানোর জন্য চার কোটি টাকা ব্যয় করে একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করে দিয়েছি। সব প্রক্রিয়া শেষ করে এটি অনুমোদনের জন্য চেষ্টা করছি। এটি অনুমোদন হতে একটু সময় লাগবে। নিজের জেলা শহরের জন্য কাজ করার চেষ্টা করছি। এই শহরের রাস্তাঘাট ঠিক করতে হবে। শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। পরিকল্পিতভাবে কুমিল্লা শহরকে সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন করতে হবে। ৫০ বছরের লক্ষ্য নিয়ে শহর উন্নয়ন করতে হবে।’

নগর ভবন সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান শেল্‌টেক্‌ প্রাইভেট লিমিটেড দুই কোটি টাকা ব্যয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের কারিগরি সহায়তায় কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের জন্য ২০ বছর মেয়াদি একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করে। প্রস্তাবিত ওই মহাপরিকল্পনা অনুমোদনের জন্য ২০১৪ সালের ২০ নভেম্বর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিবের কাছে জমা দেন মেয়র মো. মনিরুল হক। এতে চারটি ধাপে পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্প নেওয়া হয়। বর্তমানে এ-সংক্রান্ত নথিটি স্থানীয় সরকার বিভাগে রয়েছে।

মো. তাজুল ইসলাম, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী

নথি ঘেঁটে জানা গেছে, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনায় রয়েছে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা মোতাবেক স্থাপনা তৈরির প্রস্তাবনা। সড়কের প্রস্থ বাড়ানো, যানজট নিরসনের জন্য নগরের বাস টার্মিনাল স্থানান্তর, সড়কের মধ্য থেকে পরিত্যক্ত স্থাপনা অপসারণ, পুরোনো গোমতী নদীকে সৌন্দর্যবর্ধন করে বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলা, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকা ১৫০ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত সম্প্রসারণ, নগরের ১০ নম্বর ওয়ার্ডকে সরকারি অফিস জোন করা, নগরের সুজানগর এলাকায় পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য সেবক কলোনি করা, জনবল কাঠামো বাড়ানো, ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য জমি অধিগ্রহণ ও উপশহর করার প্রস্তাবও রয়েছে।

মহাপরিকল্পনা অনুমোদনের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে, আমাকে কেউ বলেনি। আমি তো প্রায় আড়াই বছর এই মন্ত্রণালয়ে আছি। আমাকে জানালে আমি সেটি দেখতাম।
মো. তাজুল ইসলাম, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী

করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শেখ মো. নুরুল্লাহ বলেন, শাসনগাছা বাস টার্মিনাল সরিয়ে আলেখারচর নেওয়া হচ্ছে। চকবাজার বাস টার্মিনাল শহরতলির বারপাড়া এলাকায় নেওয়া হচ্ছে। আশ্রাফপুর-জাঙ্গালিয়া কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের জন্য তিন একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে নগরের মোস্তফাপুর এলাকায় ট্রাক টার্মিনাল হবে। এ ক্ষেত্রে মহাপরিকল্পনা মোতাবেক ডিপিপি করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, পুরোনো গোমতী নদীর পানিপ্রবাহ চারটি স্থানে বন্ধ করে দিয়ে রাস্তা করা হয়েছে। তার ওপর নদীর দুই কূলের মানুষ নদী দখল করে নানা ধরনের স্থাপনা ও বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। পুরোনো গোমতী নদীর সড়ক তুলে দিয়ে উড়ালসেতু করা হবে। তখন নদীতে নৌকা চলবে। নদীর চারপাশের স্থাপনা সরিয়ে হাঁটার পথ তৈরি করা হবে। উন্নয়ন হচ্ছে প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনার আলোকেই।

করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মো. সফিকুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, যখন মহাপরিকল্পনা করা হয়, তখন জায়গা খালি ছিল। সড়কও বর্ধিত করা যেত। পরিকল্পিতভাবে স্থাপনা নির্মাণ করা যেত। এখন সর্বত্রই অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনা গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন স্থানে জঞ্জাল তৈরি হয়েছে। এটা দূর করা কঠিন হবে। কে কার জায়গা ছাড়বে?

* ২০১২ সালে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান শেল্‌টেক্‌ প্রাইভেট লিমিটেড দুই কোটি টাকা ব্যয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের কারিগরি সহায়তায় কুমিল্লা সিটির জন্য ২০ বছর মেয়াদি একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করে। * মহাপরিকল্পনায় সড়কের প্রস্থ বাড়ানো, নগরের বাস টার্মিনাল স্থানান্তর, সড়কের মধ্য থেকে পরিত্যক্ত স্থাপনা অপসারণ, পুরোনো গোমতী নদীকে সৌন্দর্যবর্ধন করে বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলার প্রস্তাবও রয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা শাখার সভাপতি মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, জনগণের করের টাকায় মহাপরিকল্পনা করা হলো। কিন্তু সেটার অনুমোদন হলো না এখনো, এটা দুঃখজনক। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গৌরবের শহর কুমিল্লা একসময় গোছানো শহর ছিল। গত এক দশকে বহুতল ভবনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় নগরের সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে। কোথায় কোন স্থাপনা হবে, ময়লা কোথায় ফেলা হবে, সেটাও নির্ধারণ করা হয়নি। মহাপরিকল্পনা অনুমোদন হলে, সেটা ধরে পরিকল্পিত নগরায়ণ করা যেত।

কুমিল্লা নগরের বাদুড়তলায় পরিত্যক্ত স্থাপনা সরানো হয়নি। ৮ জুন বিকেলে। এম সাদেক

মেয়র মো. মনিরুল হক বলেন, ‘৫০ বছরের কথা চিন্তা করে মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে। এ জন্য ২০ বছরে ৪ ধাপে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করে পরিকল্পনামতো উন্নয়ন করা হবে। কিন্তু মহাপরিকল্পনার প্রস্তাবনা জমা দেওয়ার সাড়ে ছয় বছর পেরিয়ে গেছে, এখনো অনুমোদন মেলেনি। অনুমোদন পেলে সেই মোতাবেক পুরোপুরি কাজ হতো। এরপরও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। মানুষ এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়তে চায় না।’

করপোরেশনই প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনা লঙ্ঘন করেছে

কুমিল্লা নগরের কান্দিরপাড় এলাকায় জরিপকাজ পরিচালনার সময় নিউমার্কেটের সামনের সড়ক ফাঁকা ছিল। ওই সময়ে নগরের উত্তরাঞ্চলের (এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের সংযোগ) সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ মসৃণ করার জন্য মহাপরিকল্পনায় সড়কের এই অংশ বড় করার ওপর জোর দেওয়া হয়। মহাপরিকল্পনার নকশায় সড়কের প্রস্থ ৩০ মিটার দেখানো আছে। কিন্তু ইতিমধ্যে ওই স্থানে ২০১৩-১৪ সালে ‘কুমিল্লা সিটি মার্কেট’ তৈরি করে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন। এতে সড়ক সংকুচিত হয়ে গেছে। বর্তমানে এ সড়কের প্রস্থ ৮ মিটার। ফুটপাত ও নিউমার্কেটের সামনের খালি জায়গাসহ ১৫ মিটার।

কুমিল্লার পুরাতন গোমতী নদীর দুই ধার দখলমুক্ত করে হাঁটার সড়ক করার কথা। ৪ জুন নগরের চানপুর এলাকায়।
প্রথম আলো

সরেজমিনে দেখা গেছে, ছয়তলা ওই স্থাপনার কারণে নগরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড় এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন। ওই ভবনের কারণে কান্দিরপাড় টাউন হল মাঠ ও কুমিল্লা ক্লাব ঢেকে আছে। মার্কেটটির দোতলা পর্যন্ত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে। অপর চারটি তলা খালি পড়ে আছে। সেখানে মাদকসেবীরা আড্ডা দেয়। উপরন্তু যাঁরা দোকান বরাদ্দ নিয়েছেন, তাঁদের অর্ধেকের মতো চুক্তি বাতিল ও অন্যত্র বিক্রির চেষ্টা করছেন। সেখানে প্রতিনিয়ত যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। জানতে চাইলে মেয়র মো. মনিরুল হক বলেন, ‘আগে ওই স্থানে দোতলা মার্কেট ছিল। তখন আমরা সিটি করপোরেশনের আয় বাড়ানোর জন্য ছয়তলা মার্কেট করেছিলাম।’