মা-বাবা শয্যাশায়ী, তাঁদের ছেড়ে চারটি বিবর্ণ ঈদ নাজমুলের

করোনাকালে অসহায় এক ব্যক্তি জেলা প্রশাসনকে ফোন করেছিলেন। তাঁর বাড়িতে চালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দেন কর্মকর্তা নাজমুল হুদা। গত মঙ্গলবার রাতে বরিশাল নগরের কাউনিয়া এলাকায়।
ছবি: প্রথম আলো

মা ক্যানসারে আক্রান্ত। বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবাও অনেকটা শয্যাশায়ী। তবু তাঁদের দেখতে যেতে পারেন না ছেলে নাজমুল হুদা। করোনাকালে কাঁধে চাপা দায়িত্ব গত চারটি ঈদ পরিবার-পরিজনের সঙ্গে কাটাতে দেয়নি জেলা প্রশাসনের এই কর্মকর্তাকে। দেড় বছর আগে বাড়িতে গিয়েছিলেন। এরপর আর অসুস্থ মা–বাবার সঙ্গে দেখা হয়নি। এবারও সেই একই রকম বিবর্ণ ঈদ কাটালেন তিনি।

নাজমুল হুদা বরিশাল জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার। প্রশাসনের সবচেয়ে ব্যস্ততম দপ্তর নেজারতের ডেপুটি কালেক্টরের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে।

গত বছর মার্চে বরিশাল বিভাগে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়। এরপর থেকে দায়িত্বের চাপ আরও বেড়ে যায় নাজমুল হুদার। স্বাস্থ্যবিধি রক্ষায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, কখনো করোনাকালে কাজ হারানো মানুষের কাছে খাদ্যসহায়তা নিয়ে রাতবিরাতে অসহায় মানুষের দ্বারে খাবার পৌঁছে দেওয়া, কখনো প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার মতো দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ছুটে চলা। ফলে আগের তিনটি ঈদ স্বজনদের কাছে গিয়ে উদ্‌যাপন করতে পারেননি নাজমুল হুদা। এর মধ্যে গত মাসে তিনি বাবা হয়েছেন। ভেবেছিলেন, এবার করোনার প্রকোপ কিছুটা কমলে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে পরিবারের সঙ্গে কোরবানির ঈদ উদ্‌যাপন করতে পারবেন। কিন্তু উল্টো করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। বাড়িতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি নাজমুলের।

নাজমুল বলেন, ‘স্বজনদের ছাড়া ঈদের দিনগুলো বিবর্ণ হয়ে ওঠে। কষ্টে অনেক সময় চোখে জল এসে গেছে। বিশেষ করে মা দুরারোগ্য রোগে শয্যাশায়ী। মা-বাবা যখন ফোন করেন, তখন আমি নিজেকে সামলাতে পারি না। গতকাল (মঙ্গলবার) মা বলছিলেন, “বাবা তোমার সঙ্গে কী আর আমার ঈদ করা হবে?” আমি জবাব দিতে পারিনি। নীরবে শুধু কেঁদেছি।’

মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে নাজমুল হুদা। জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার মৈশাইর গ্রামে। বাবা সাদেক উল্লাহ মুদি ব্যবসা করতেন। বয়সের ভারে এখন কাজকর্ম ছেড়ে দিয়েছেন। নাজমুলের মা মনোয়ারা বেগম ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত। স্ত্রী তাসনোভা জান্নাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের শিক্ষার্থী। এখন সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুকে নিয়ে তিনি নরসিংদীতে তাঁর বাবার বাড়ি আছেন।

নাজমুল হুদা
ছবি: সংগৃহীত

পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে নাজমুল ছোটবেলা থেকেই মেধাবী। ২০০২ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় আশুগঞ্জ উপজেলার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এসএসসিতে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পান। এইচএসসিতেও তা-ই। কুমিল্লা বোর্ডে মেধাতালিকায় চতুর্থ হন। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থা বিভাগে। পড়াশোনা শেষ করে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নেন।

বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারসহ সরকারের প্রথম শ্রেণির আটটি চাকরিতে সুপারিশপ্রাপ্ত হন নাজমুল। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মজীবনের পথচলা শুরু। পরবর্তী সময়ে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পেলে ২০১৯ সালের ৮ এপ্রিল সহকারী কমিশনার হিসেবে বরিশাল জেলা প্রশাসনে যোগ দেন। ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও ইয়াস এবং করোনা দুর্যোগকালে নিরলস কাজ করেছেন নাজমুল হুদা।

বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার বলেন, নাজমুলসহ জেলা প্রশাসনের সব ম্যাজিস্ট্রেটই দায়িত্বের ব্যাপারে খুবই অঙ্গীকারবদ্ধ। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি উপেক্ষা করে তাঁরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছেন।