মাইকের ব্যবসায় নেমে আসা নীরবতা
একটা সময় ছিল যখন বিয়ে, জন্মদিন, যাত্রাপালাসহ যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানেই মাইকের ব্যবহার দেখা যেত। এসব অনুষ্ঠানের দুই–এক দিন আগে থেকেই মাইক ভাড়া নেওয়ার জন্য দোকানগুলোয় ক্রেতাদের আনাগোনা দেখা যেত। তবে সময়ের ব্যবধানে পাল্টেছে দৃশ্যপট। এখন আর অনুষ্ঠানগুলোয় মাইকের তেমন কদর নেই।
১৯৮০ সালের দিকে গাজীপুরের জয়দেবপুরে ছোট্ট একটি দোকান করেছিলেন যোগীতলা গ্রামের মাহাজউদ্দিন। ওই সময় কলের গান খুব জনপ্রিয়। মাহাজউদ্দিনের দোকানে কলের গান ভাড়া পাওয়া যেত। প্রতিদিনই কোনো না কোনো অনুষ্ঠানে তাঁর ডাক পড়ত। তিনিও কলের গানের সঙ্গে মাইক নিয়ে ছুটে যেতেন অনুষ্ঠানে। বেশ জমজমাট ছিল এই ব্যবসা।
তবে এমন জমজমাট ব্যবসা খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় দিন দিন বাজারে আসতে থাকে অত্যাধুনিক সব শব্দব্যবস্থা। বিশেষ করে অত্যাধুনিক সাউন্ডবক্সের সঙ্গে বিভিন্ন গ্রেডের অ্যামপ্লিফায়ারের দাপটে কমতে থাকে তাঁর দোকানের চাহিদা। একপর্যায়ে দোকান ভাড়া ও অন্যান্য খরচ নিয়ে শহরে টিকতে না পেরে গ্রামে এসে মাইকের দোকান দেন।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে যোগীতলা বাজারে গিয়ে দেখা যায়, টিনের চালাঘরে মাহাজউদ্দিনের মাইকের দোকান। ভেতরে মেঝে ও টিনের দেয়ালে সাজিয়ে রাখা ২০ থেকে ২৫টি মাইক। পাশেই একটি তাকের ওপর আগের দিনের কয়েকটি এমপ্লিফায়ার, সার্কিটবোর্ড, সিডি ক্যাসেট, ডিভিডি ক্যাসেটসহ কয়েকটি ব্যাটারি। সবগুলোর জিনিসের ওপরই পড়ে আছে ধুলোর আস্তরণ। দেখে বোঝা গেল, এসব অনেক দিন ব্যবহার হয় না। দোকানে মাহাজউদ্দিন ছাড়া আর কেউ নেই। দোকানের ভেতরে ঢোকার পরই মাহাজউদ্দিনের প্রত্যাশা ছিল, মাইক ভাড়া নিতে হয়ত ক্রেতা এসেছেন। তবে পরিচয় জেনে মাহাজউদ্দিন কিছুটা হতাশই হলেন।
ব্যবসা কেমন চলছে?—জিজ্ঞাসা করতেই মাহাজউদ্দিন হতাশাসূচক উত্তর, ‘আর চলছে! এহন আর কেউ মাইক নেয় না। সবাই আধুনিক জিনিসপত্রের দিকে ছোডে। আমার শেষ বয়স, অন্যকোনো কাম শিহি নাই, হেললাইগ্যা এইডা নিয়াই পইড়া আছি। এহন আর এ ব্যবসা চলে না।’
বাজার থেকে কিছুটা এগোলেই মাহাজউদ্দিনের বাসা। তাঁর দুই ছেলে স্ত্রী–সন্তান নিয়ে থাকেন ভিন্ন সংসারে। মাহাজউদ্দিন ও তাঁর স্ত্রীর আলাদা সংসার। এই ব্যবসার ওপর নির্ভর করেই মাহাজউদ্দিনের সংসার চালাতে হয়।
মাহাজউদ্দিন বলেন, ‘১০ বছর আগেও প্রতি মাসে গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার ট্যাকা ইনকাম হইত। ৫ থেকে ৬ জন কর্মচারী ছিল দোকানে। কিন্তু এখন মাসে ৫ হাজার ট্যাকারও কাজ হয়ও না। কর্মচারী রাখা তো দূরের কথা, নিজের পেটই চলে না।’
মাহাজউদ্দিন আরও বলেন, শীতকালে মাইকের চাহিদা বাড়ে। তখন চারদিকে ওয়াজ মাহফিলের অনুষ্ঠান হয়। এর বাইরে কনসার্ট, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক সভাগুলোতে মাইকের ব্যবহার হয়। তবে এসব অনুষ্ঠানও আগের মতো হয় না। আর গেল দুই বছরে করোনার প্রকোপে এ ধরনের অনুষ্ঠান বন্ধ ছিল বললেই চলে।
মাহাজউদ্দিন বলেন, ‘আগে শীতডা আইলেই দম ফালানির উপায় আছিল না। ওয়াজ মাহফিল, বিয়ের অনুষ্ঠানের লাইগ্যা দুই–তিন আগ থ্যাইক্যাই ভিড় লাইগ্যা যাইত। কিন্তু এহন এইসবের কিছুই অয় না। আবার মাঝে করোনা আছিল। এখন ভিড় লাগা তো দূরের কথা, মাসে ৪–৫টা কাম অয় কি না সন্দেহ।’
মাহাজউদ্দিন বলেন, মাইকের চাহিদা কমতে থাকায় তার আশপাশে অনেকেই ব্যবসায়ী জীবনধারণের জন্য ব্যবসার ধরন পাল্টেছেন। মাইক বাদ দিয়ে কেউ দোকানে তুলেছেন ইলেকট্রনিকস পণ্য, আবার অনেকে অত্যাধুনিক সাউন্ডসিস্টেম। এর মধ্যে অনেকে এই ব্যবসাই ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু পুঁজি না থাকায় এসবের কিছুই করতে পারেননি মাহাজউদ্দিন।
আক্ষেপ নিয়ে মাহাজউদ্দিন বলেন, ‘ইচ্ছা ছিল দোকানডারে বড় করুম। কিন্তু ট্যাকার লাইগ্যা পারি নাই। কিছু ট্যাকাও জমাইছিলাম, কিন্তু অভাবের কারণে সেইডাও খরচ হইয়্যা গেছে। এহন এইড্যা ছাড়া কোনো গতি নাই।’