মাটি ছাড়াই চারা উৎপাদন

মাটির বদলে ব্যবহার করা হয় প্লাস্টিকের ট্রে ও প্লাস্টিকের ছোট ছোট গ্লাসে কচুরিপানা ও নারিকেলের ছোবড়ার সংমিশ্রণ।

নার্সারিতে কাজ করছেন শ্রমিকেরা। গত বুধবার দিনাজপুরের বেলবাড়ি এলাকায়
প্রথম আলো

রাস্তার দুই ধারে শীতকালীন সবজির খেত। বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মরিচ, টমেটোসহ নানা ধরনের সবজি। এরই মধ্যে চারদিকে বেড়া দেওয়া ফারমার্স হাব সবজি নার্সারি। সেখানে মাটি ছাড়াই চারা তৈরি করা হয়। মাটির বদলে ব্যবহার করা হয় প্লাস্টিকের ট্রে ও প্লাস্টিকের ছোট ছোট গ্লাসে কচুরিপানা ও কোকোডাস্টের (নারিকেলের ছোবড়া) সংমিশ্রণ।

নার্সারিটির মালিক জামালউদ্দিন (৩২)। দিনাজপুর শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে বেলবাড়ি বাজারসংলগ্ন বাড়ির পাশেই নার্সারি গড়ে তুলেছেন তিনি।

জামালউদ্দিন ওই এলাকার মো. ইব্রাহিমের ছেলে। নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন জামালউদ্দিন। নিজেদের দুই বিঘা জমিসহ অন্যের জমি বর্গা নিয়ে বাবার সঙ্গেই কৃষিকাজ করতেন। ২০১৭ সালের শেষে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) সহযোগিতায় গড়ে তুলেছেন এই নার্সারি। চারার ব্যবসা করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। প্রসারিত করেছেন নার্সারি। নার্সারি থেকে আয়ের টাকায় নির্মাণ করেছেন বসতবাড়ি।

গত বুধবার জামালউদ্দিনের নার্সারিতে গিয়ে দেখা যায়, বাপ–ছেলেসহ কয়েকজন কৃষিশ্রমিক নিয়ে ব্যস্ততম সময় পার করছেন। পলি হাউসে প্লাস্টিক ট্রেতে বীজ বপন করা হচ্ছে। মাটির বদলে নারকেলের ছোবড়া থেকে তৈরি কোকোপিট প্রক্রিয়াজাত ও জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করা হয়েছে। চারার সুরক্ষার জন্য ওপরে শেডনেট জুড়ে দিয়ে তাপ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। প্রায় দুই বিঘা জমির ওপর পলিশেডের নিচে ছোট–বড় ৫৫টি বেড। প্লাস্টিকের ট্রে ও গ্লাসে ২ পাতা–৪ পাতাবিশিষ্ট টমেটো, মিষ্টিকুমড়া, ফুলকপি, বাঁধাকপির চারা সদ্য চোখ মেলে উঁকি দিতে শুরু করেছে।

জামালউদ্দিনের হিসাবে, বর্তমানে নার্সারিতে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ১০ লাখ চারা রয়েছে। প্রতিটির চারার দাম দেড় টাকা থেকে ২৫ টাকা।

নার্সারি ব্যবসার শুরুর কথা জানালেন জামালউদ্দিন। বেলবাড়ি বাজারে চায়ের দোকানে পরিচয় হয় গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রের মাঠকর্মী মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে। সংস্থাটি কৃষকদের মাটি ছাড়াই চারা উৎপাদনের কাজ করছিল। জামালউদ্দিন বলেন, ‘প্রথম থেকেই তাদের পরামর্শ গুরুত্ব দিয়ে শুনেছি। তাদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিই। সেখান থেকেই জানতে পারি, প্রচলিত পদ্ধতিতে একই জমিতে বারবার চারা উৎপাদন করায় জমিগুলো রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এই পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করলে অল্প খরচে সুস্থ–সবল চারা উৎপাদন করা যায়। প্রশিক্ষণের পর চারা তৈরি জন্য ট্রে, প্লাস্টিকের গ্লাস, নেট, নারিকেলের ছোবলাসহ যাবতীয় কাঁচামাল কিনে চারা উৎপাদন শুরু করি। প্রাথমিকভাবে খরচ হয়েছিল ৫০ হাজার টাকা।’

জামালউদ্দিন জানালেন, বাড়ির ভেতরে ৫০ বর্গফুটের চৌবাচ্চা। সেখানে নারিকেলের ছোবড়া, গোবর, কচুরিপানাসহ প্রয়োজনীয় কিছু রাসায়নিক সার দিয়ে ১৫ দিন ঢেকে রাখেন। আস্তে আস্তে সেগুলো পচে যায়। পরে সেগুলো গুঁড়া করে পরিমাণমতো ট্রে ও গ্লাসে দিয়ে বীজ বপন করা হয়। তিন দিনের মধ্যে বীজ থেকে অঙ্কুর বের হয় এবং ১৫ দিন পরে চারা বিক্রির উপযোগী হয়। দৈনিক ৮-১০ হাজার চারা বিক্রি করেন। গড়ে প্রতিদিন ১২-১৪ হাজার টাকার চারা বিক্রি হয়। খরচ বাদ দিয়ে মাসে ৫০ হাজার টাকার বেশি লাভ থাকে।

সাধারণত নার্সারিতে এসেই ক্রেতারা চারা কিনে নিয়ে যান। কেউবা খুচরা ও কেউবা পাইকারিতে চারা কেনেন। অনেকে ভার্মি কম্পোস্ট সার কোকোপিট কেনেন ২০ টাকা কেজিদরে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক তৌহিদ ইকবাল বলেন, কয়েক বছর ধরে হর্টিকালচার সেন্টারের মাধ্যমে কোকোপিটের মিশ্রণে ট্রে পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে চারা মাটিবাহিত রোগ–বালাই থেকে মুক্ত থাকে। কোকোপিট মাটির তুলনায় অনেক হালকা। এতে চারা স্থানান্তরের সময় গাছের গোড়া আঘাতপ্রাপ্ত হয় না।