মাটির ব্যাংকে জমানো টাকায় মানুষের পাশে সানজিদা

সানজিদা জেরিন
ছবি: সংগৃহীত

করোনার আতঙ্কে মানুষ ঘরবন্দী। ভয় উপেক্ষা করে সাহস নিয়ে কাজ হারানো অসহায় মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ান আইনের শিক্ষার্থী সানজিদা জেরিন। অসহায় মানুষের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দেওয়ার জন্য নিরন্তর ছুটে চলেন তিনি। মাটির ব্যাংকে জমানো সাড়ে ২৭ হাজার টাকা দিয়ে চাল-ডাল-সবজি কিনে মানুষের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেন। সানজিদার এই কাজ এখনো চলছে।

চলতি বছরের মার্চ মাসে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হয়। এ সময় সানজিদা যশোরের মণিরামপুর উপজেলার হাসাডাঙ্গা গ্রামের শিশুদের মাঠে খেলার জন্য একটি ফুটবল কিনে দেন। ফুটবল দিতে তিনি ওই গ্রামে গিয়ে দেখেন, এক নারী রাস্তার ওপরে বসে কাঁদছেন। এগিয়ে গিয়ে জানতে পারেন, তাঁর স্বামী জুটমিলের শ্রমিক ছিলেন। করোনা পরিস্থিতিতে মিল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কাজ নেই। ঘরে কোনো খাবার নেই। সন্তানদের নিয়ে তাঁর অসহায় অবস্থা। সানজিদার কাছে থাকা ২০০ টাকা ওই নারীকে দেন। পরে সানজিদা জানতে পারেন, ওই গ্রামের অধিকাংশ মানুষ দিনমজুর ও দরিদ্র। গ্রামটি বছরের একটা সময় জলাবদ্ধ থাকে। এরপরই তিনি গ্রামের বাসিন্দাদের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন।

বছর চারেক আগে সানজিদা যশোর সদর উপজেলার হামিদপুর আল হেরা ডিগ্রি কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে লেখাপড়া করতেন। তখন বাবার কাছ থেকে নেওয়া মেস খরচের টাকা থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে মাটির ব্যাংকে জমা করতেন। ৩ বছরে ২টি মাটির ব্যাংকে ২৭ হাজার ৫৯০ টাকা জমা হয়। ওই ব্যাংক ভাঙেন তিনি। একটি পরিবারের এক সপ্তাহের চাহিদা মেটে এমন পরিমাণ চাল-ডাল-তেল-লবণ কিনে পৌঁছে দেন অন্তত ২৫০ পরিবারে। তাঁর এই উদ্যোগ দেখে বাবাসহ অন্য আত্মীয়স্বজন তাঁকে টাকা দিয়ে অনুপ্রেরণা দেন।

সানজিদা বর্তমানে ঢাকার ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে আইন বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন। অসহায় মানুষের সাহায্যে টাকার জোগান বাড়াতে তিনি অনলাইনে হস্তশিল্পের পণ্য ও প্রসাধনসামগ্রী বিক্রিও শুরু করেন।

এরপর সানজিদা পুরোদমে নেমে পড়ে করোনাযুদ্ধ জয়ে। নিজেই কাঁধে যন্ত্র বেঁধে গ্রামের পথে পথে ঘুরে জীবাণুনাশক ওষুধ ছিটান। কৃষকের মাঠ থেকে সবজি কিনে ভ্যানে করে নিয়ে বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে তা বিতরণ করেন। ভিটামিন ও প্যারাসিটামল–জাতীয় ওষুধ নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি ছুটে যান।

অসহায় মানুষের সাহায্যে টাকার জোগান বাড়াতে তিনি অনলাইনে হস্তশিল্পের পণ্য ও প্রসাধনসামগ্রী বিক্রিও শুরু করেন। সেই ব্যবসার টাকা থেকে লভ্যাংশ দিয়ে তিনি এখনো মানুষকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন।

সানজিদা বর্তমানে ঢাকার ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে আইন বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন। তাঁর বাবা নজরুল ইসলাম ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা হিসেবে যশোরের কেশবপুর উপজেলার সাতবাড়িয়া ইউনিয়নে কর্মরত।

সানজিদা বলেন, ছোটবেলা থেকেই মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছা ছিল মনে। কলেজে পড়ার সময় মেস খরচ থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে মাটির ব্যাংকে জমা করতেন। করোনা পরিস্থিতিতে টিকে থাকার একটা যুদ্ধ চলছিল। তখন ভাবেন টাকা মাটির ব্যাংকে ফেলে রেখে লাভ কী!

খাদ্যসহায়তা বিতরণের জন্য তৎকালীন মণিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উপজেলার প্রতিটা ইউনিয়নে স্বেচ্ছাসেবকদের একটি টিম গঠন করেন। সানজিদাকে উপজেলা টিমের সহকারী মেন্টর নির্বাচন করা হয়।

সানজিদা করোনা পরিস্থিতিতে এলাকায় ভালো কাজ করেছেন। তাঁকে আরও অনুপ্রেরণা দেওয়া দরকার।
আবদুল হক, খেদাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান

সানজিদা বলেন, সরকারি ত্রাণ ভাগ–বাঁটোয়ারা হয়ে যেত। প্রকৃত অসহায়দের কাছে ঠিকমতো পৌঁছাত না। তাই বাবা ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ওষুধ, সবজি, শীতবস্ত্র কিনে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান। এই শীতে কম্বল ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণের জন্য তাঁর বাবা তাঁকে ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন। ইতিমধ্যে গত ডিসেম্বর মাসে ৫৫ জনকে কম্বল ও ৩৫ পরিবারে চাল-ডাল-তেল-লবণ দেওয়া হয়েছে।

সানজিদার এই কার্যক্রম সম্পর্কে মণিরামপুর উপজেলার খেদাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল হক বলেন, সানজিদা করোনা পরিস্থিতিতে এলাকায় ভালো কাজ করেছেন। তাঁকে আরও অনুপ্রেরণা দেওয়া দরকার।