মাঠে দোল খাচ্ছে সাদা ফুলের ‘কালো সোনা’
মাঠে মাঠে দোল খাচ্ছে সাদা সাদা ফুল। এসব ফুলের ভেতর লুকিয়ে আছে কুচকুচে কালো বর্ণের পেঁয়াজবীজের দানা। বাজারে চড়া দামের কারণে অনেক কৃষকই এসব বীজকে ‘কালো সোনার’ সঙ্গে তুলনা করেন। অর্থনৈতিকভাবে বেশ লাভজনক হওয়ায় পেঁয়াজবীজ উৎপাদন ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। কিন্তু মৌমাছি–সংকটে পেঁয়াজ ফুলে পরাগায়ন না ঘটায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। অনেক কৃষক পেঁয়াজবীজ খেতে মৌমাছির বাসা বসিয়ে ও হাতের স্পর্শে কৃত্রিমভাবে পরাগায়ন ঘটানোর চেষ্টা করছেন।
পেঁয়াজবীজ নিয়ে এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন ঠাকুরগাঁওয়ের চাষিরা। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ইয়াকুবপুর, গড়েয়া ও বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ধনতলা, চাড়োল ও রানীশংকৈল উপজেলার লেহেম্বা, বনগাঁও ও গোগর এলাকা ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে।
কয়েকজন চাষি জানালেন, সাধারণত নভেম্বর মাস বীজতলায় বা জমিতে পেঁয়াজবীজ বপনের সময়। বীজ পরিপক্ব হতে সময় লাগে ১৩০ দিন। পরাগায়ন না হলে পেঁয়াজ ফুলে পরিপক্বতা আসে না। আর এসব ফুলে পরাগায়নের প্রধান মাধ্যম হলো মৌমাছি। পোকার আক্রমণ থেকে ফসল বাঁচাতে কৃষকেরা খেতে কীটনাশক ছিটান। কিন্তু সেই কীটনাশকে মারা পড়ছে উপকারী পোকা ও মৌমাছি। এ কারণে পেঁয়াজবীজের খেতে দিন দিন মৌমাছির আনাগোনা কমে যাচ্ছে। চলতি বছর পেঁয়াজ ফুলে আশানুরূপ দানা তৈরি না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে তাঁরা খেতে মৌমাছির বাসা বসিয়ে এবং ঝাড়ু ও হাতের স্পর্শে কৃত্রিমভাবে পরাগায়নের চেষ্টা করছেন।
বীজ উৎপাদন শেষে কোম্পানির কাছ থেকে প্রতি কেজি বীজের বিপরীতে কৃষক পান ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা।
রানীশংকৈল উপজেলার বনগাঁও গ্রামের পয়গাম আলী কৃষি বিভাগের সহায়তায় দুই বিঘা জমিতে বারি-১ জাতের পেঁয়াজবীজের চাষ করছেন। তিনি বলেন, বাজারে পেঁয়াজবীজের যে চড়া দাম, তাতে পেঁয়াজবীজ চাষ এখন তাঁর কাছে সোনা চাষের মতো। লাভজনক হওয়ায় কয়েক বছর ধরেই চাষিরা পেঁয়াজবীজ উৎপাদনে ঝুঁকছেন। এবার তাঁর জমিতে ৭০০–৮০০ কেজি বীজ উৎপাদিত হবে বলে আশা করছেন। পরাগায়নের জন্য তিনি খেতে মৌমাছির বাক্স বসিয়েছেন।
স্থানীয় পেঁয়াজচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পেঁয়াজবীজ চাষ কিছুটা ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেক চাষি বীজ উৎপাদনের জন্য বীজ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেন। বীজ কোম্পানি চাষিদের পেঁয়াজবীজ সরবরাহ করে। এরপর চাষিরা খেতে বীজ লাগানো ও পরিচর্যা করেন নিজের খরচে। বীজ উৎপাদন শেষে কোম্পানির কাছ থেকে প্রতি কেজি বীজের বিপরীতে পান ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা।
চলতি বছর জেলায় ১৩৩ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন ব্লক তৈরি করা হয়েছে। এর বাইরেও অনেক কৃষক ব্যক্তিগত উদ্যোগে পেঁয়াজবীজ উৎপাদন করছেন।
সদর উপজেলার মণ্ডলপাড়া গ্রামের কৃষক কৃষ্ণকান্ত চলতি বছর এক বিঘা জমিতে পেঁয়াজের বীজ আবাদ করেছেন। ফুলে পরাগায়ন ঘটানোর জন্য তিনি দুজন নারী শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছেন। তাঁরা প্রতিদিন হাতের স্পর্শে এক ফুলের সঙ্গে অন্য ফুলের পরাগায়ন ঘটান। সবকিছু ঠিক থাকলে দেড় লাখ টাকার ওপরে বীজ বিক্রির আশা করছেন কৃষ্ণকান্ত।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ধনতলা গ্রামের পেঁয়াজচাষি অশোক বর্মণ বলেন, পেঁয়াজের দানাকে অনেকে ‘ব্ল্যাক গোল্ড’ বলে অভিহিত করলেও পেঁয়াজবীজ তাঁর কাছে ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ডের’ মতো। কিন্তু এ বছর এই পেঁয়াজের ফুলে মৌমাছি না বসায় পরাগায়নে সমস্যা হয়। এতে ফুলগুলো শুকিয়ে ঝরে যেতে থাকে। পরে কৃষি বিভাগের পরামর্শে তাঁরা খেতে হাত দিয়ে কৃত্রিমভাবে পরাগায়ন শুরু করেন।
পেঁয়াজ ফুলে পরাগায়নের প্রধান মাধ্যম হলো মৌমাছি। ফসলি জমিতে অতিমাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগের কারণে দিন দিন মৌমাছি কমে যাচ্ছে, যা আশানুরূপ পেঁয়াজবীজ ফলনের ওপর প্রভাব ফেলে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঠাকুরগাঁও কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর জেলায় ১৩৩ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন ব্লক তৈরি করা হয়েছে। এর বাইরেও অনেক কৃষক ব্যক্তিগত উদ্যোগে পেঁয়াজবীজ উৎপাদন করছেন।
পেঁয়াজবীজ চাষ সম্পর্কে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রানীশংকৈল কার্যালয়ের উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জয় দেবনাথ বলেন, পেঁয়াজ ফুলে পরাগায়নের প্রধান মাধ্যম হলো মৌমাছি। ফসলি জমিতে অতিমাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগের কারণে দিন দিন মৌমাছি কমে যাচ্ছে, যা আশানুরূপ পেঁয়াজবীজ ফলনের ওপর প্রভাব ফেলে। তবে চাষিরা কৃত্রিমভাবে পরাগায়ন ঘটানোর কারণে পেঁয়াজবীজ উৎপাদনের ওপর খুব একটা প্রভাব পড়ছে না।