মাঠের রোদ–গরম থেকে কৃষককে রক্ষায় রাজুর ‘সোলার ফ্যান’

রাজু আহম্মেদের ‘সোলার ফ্যান’ পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করছেন এক কৃষক। গতকাল বুধবার দুপুরে জামালপুরের শরিফপুর এলাকায়।
ছবি: প্রথম আলো

ফসলের মাঠে রোদ আর গরম কৃষকের নিত্যদিনের কষ্ট। এ কষ্ট দূর করতে নতুন একটি যন্ত্র বানিয়েছেন জামালপুরের রাজু আহম্মেদ। নাম দিয়েছেন ‘সোলার ফ্যান’। যন্ত্রটি কৃষকের মাথায় ছায়া ও দুই পাশ থেকে শীতল বাতাস দেবে। ফলে কৃষক ক্লান্তিহীনভাবে মাঠে টানা কাজ করতে পারবেন বলে দাবি রাজুর। অনেকেই যন্ত্রটি দেখতে ভিড় করছেন।

রাজু আহম্মেদ পেশায় ইলেকট্রিশিয়ান। তাঁর বাড়ি জামালপুর সদর উপজেলার শরিফপুর ইউনিয়নের ব্যাপারিপাড়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মো. ইলিয়াস। তিনি মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। শরিফপুর বাজারে তাঁর ছোট্ট একটি ইলেকট্রিকের দোকান রয়েছে।

যন্ত্রটি তৈরি করতে রাজু আহম্মেদ ২০ ওয়াটের একটি সোলার প্যানেল, ১২ ভোল্টের ডিসি ২টি ছোট্ট ফ্যান, ২টি সুইচ, ১টি বেল্ট ও বডি মেকানিক্যাল ব্যবহার করেছেন। যন্ত্রটি কৃষকের মাথায় ছায়া দেবে। অন্যদিকে সামনে থেকে একটি ফ্যান এবং পেছন থেকে একটি ফ্যান বাতাস দেবে। ফলে একজন কৃষক তাঁর পিঠে লাগিয়ে সারা দিন ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করতে পারবেন। এই যন্ত্র তৈরি করতে তিনি প্রায় এক বছর সময় নিয়েছেন।

রাজু আহম্মেদ বলেন, কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন যন্ত্র তৈরির আগ্রহ তাঁর অনেক আগে থেকেই ছিল। সেই আগ্রহ থেকে নতুন একটি যন্ত্র উদ্ভাবনের চিন্তা আসে তাঁর মাথায়। মাঠে কৃষক ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত প্রখর রোদ আর প্রচণ্ড গরমের মধ্যে কাজ করেন। তাঁদের কথা মাথায় রেখেই তিনি এই নতুন যন্ত্র তৈরির কাজ শুরু করেন। ধীরে ধীরে তিনি নকশা ও পরিকল্পনা করে যন্ত্রটি প্রস্তুত করেন। এটি বানাতে তাঁর ১ হাজার ৫০০ টাকা খরচ হয়েছে।

শরিফপুর এলাকার মির্জাপুর গ্রামের কৃষক মো. মোরতুজা যন্ত্রটি পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করেছেন। অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই কৃষিকাজ করেন তিনি। রোদ আর গরমে অনেক সময় অসুস্থ হয়ে যান। কিছুক্ষণ পরপর তাঁকে গাছের নিচে গিয়ে বিশ্রাম নিতে হয়। এতে অনেক সময় নষ্ট হয়। শরীরেও অনেক ক্লান্তি আসে। তবে ওই যন্ত্র ব্যবহার করলে রোদ আর গরম থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। সুন্দর ঠান্ডা বাতাস ও মাথায় ছায়া পড়ে। সূর্যের আলো সরাসরি মাথায় লাগে না। ওজনও কম, পিঠে লাগানো থাকলে বোঝা যায় না। শরীরেও কোনো ক্লান্তি আসে না। তবে দাম আরও একটু কম হলে কৃষক সহজেই কিনে ব্যবহার করতে পারবেন।

রাজু আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, কাজ শেখার পর থেকেই কৃষিযন্ত্র তৈরির প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল। তিনি ২০১২ সালে ঘাস কাটা, ভুট্টা বপন ও খেতের আবর্জনা পরিষ্কারের একটি যন্ত্র তৈরিও করেছিলেন। একইভাবে মুঠোফোনের মাধ্যমে পাখি তাড়ানোরও একটি যন্ত্র বানিয়ে ছিলেন। পরে তাঁর তৈরি যন্ত্রটি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা দেখেন এবং তাঁকে উৎসাহ দেন। তাঁদের সহযোগিতায় তিনি কৃষি যন্ত্রপাতি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের একটি প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেছিলেন।

সোলার ফ্যান নিয়ে তিনি বলেন, কৃষকের সুবিধার জন্য যন্ত্রটি তৈরি করলেও এটি নির্মাণশ্রমিকসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যাবে। যেসব ব্যক্তিরা মাঠে কাজ করেন, তাঁরাই যন্ত্রটি ব্যবহার করতে পারবেন। বাণিজ্যিকভাবে এই যন্ত্র উৎপাদন করা হলে এর খরচ আরও অনেক কম হবে।

একজন কৃষক তাঁর পিঠে যন্ত্রটি লাগিয়ে সারা দিন ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করতে পারবেন।
ছবি: প্রথম আলো

রাজুর যন্ত্রটি দেখেছেন জামালপুরের আঞ্চলিক কৃষি গবেষণাকেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মঞ্জুরুল কাদির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এটি নতুন একটি আইডিয়া। তবে যন্ত্রটিতে আরও কিছু কাজ করতে হবে। দাঁড়িয়ে কাজ করার জন্য খুব ভালো। কিন্তু খেত নিড়ানির জন্য একটু কঠিন হবে। ফলে যন্ত্রটির আরও মোডিফিকেশন করতে হবে, যাতে একজন কৃষক খুব সহজেই যন্ত্রটি বহন করতে পারেন। রাজুকে তাঁরা সব ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন। অল্প খরচে এই যন্ত্র কৃষক এবং যাঁরা দাঁড়িয়ে কাজ করেন, তাঁরা সবাই ব্যবহার করতে পারবেন।

মঞ্জুরুল কাদির বলেন, রাজু একজন দরিদ্র ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। কৃষিক্ষেত্রে তাঁর নতুন কিছু উদ্ভাবনের চিন্তা সব সময় মাথায় থাকে। তাঁর উদ্ভাবনের চিন্তাগুলো দারুণ। তবে আর্থিক কারণে তিনি এগোতে পারছেন না। এর আগেও তিনি খেতের পাখি তাড়ানোর একটি যন্ত্র তৈরি করেছিলেন। যন্ত্রটি মুঠোফোনে যেকোনো স্থান থেকে কল দিলেই চার ধরনের শব্দ করে এবং পাখি চলে যায় খেত থেকে। দুর্ভাগ্য, অর্থের অভাবে এসব উদ্ভাবনীকে বাণিজ্যিকভাবে তিনি বাস্তবায়ন করতে পারছেন না।