মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকায় হত্যা করা হয় সাংবাদিক মহিউদ্দিনকে

কুমিল্লার বুড়িচংয়ে গুলিতে নিহত সাংবাদিক মহিউদ্দিন ওরফে নাঈম সরকার
ছবি: সংগৃহীত

কুমিল্লার বুড়িচংয়ে গুলিতে নিহত সাংবাদিক মহিউদ্দিন ওরফে নাঈম সরকারের (২৮) গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণপাড়ায় চলছে মাতম। এ ঘটনার নিন্দা জানাচ্ছেন ব্রাহ্মণপাড়ার সাংবাদিকেরা। তাঁরা খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছেন।

পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশ ও র‌্যাবকে তথ্য দিয়ে মাদকদ্রব্য জব্দ করতে সহায়তা করায় এবং মাদক ব্যবসা নিয়ে প্রতিবেদন করায় মাদক ব্যবসায়ীরা মহিউদ্দিনের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। এ কারণেই মাদক ব্যবসায়ীরা গতকাল বুধবার রাত নয়টার দিকে বুড়িচং উপজেলার শংকুচাইলসংলগ্ন হায়দ্রাবাদ নগর এলাকায় মহিউদ্দিনকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।

মহিউদ্দিন ওরফে নাঈম সরকার কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মালাপাড়া ইউনিয়নের অলুয়া গ্রামের মোশাররফ হোসেনের ছেলে। তিনি কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত কুমিল্লার ডাক পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক ছিলেন।

মহিউদ্দিন ওরফে নাঈম সরকার কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মালাপাড়া ইউনিয়নের অলুয়া গ্রামের মোশাররফ হোসেনের ছেলে। তিনি কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত কুমিল্লার ডাক পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক ছিলেন। এর আগে তিনি আনন্দ টেলিভিশনের ব্রাহ্মণপাড়া-বুড়িচং প্রতিনিধি ছিলেন। আজ বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটায় গ্রামের বাড়িতে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তাঁর লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

মহিউদ্দিন দুই ভাই আর এক বোনের মধ্যে বড় ছিলেন। ছোট ভাই হৃদয় সরকার সৌদি আরবে থাকেন। একমাত্র বোন শারমিন আক্তারকে কুমিল্লা শহরে স্বামীর বাড়িতে থাকেন। তাঁর বাবা মোশাররফ হোসেন বাংলাদেশ পুলিশে দীর্ঘ ৩৪ বছর চাকরি শেষে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি অবসরে যান। তিনি পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক ছিলেন।

গুলিতে নিহত সাংবাদিক মহিউদ্দিনের গ্রামের বাড়িতে মাতম
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে সাংবাদিক মহিউদ্দিন ওরফে নাঈম সরকারের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, স্বজনসহ বিভিন্ন এলাকার লোকজন এবং দীর্ঘদিনের সহকর্মী সাংবাদিক ও বন্ধুরা তাঁর বাড়িতে জড়ো হয়েছেন। মহিউদ্দিনের মা নাজমা বেগম ছেলেকে হারিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। ছেলের শোকে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আর ঘরের এক পাশে শুয়ে শুয়ে কাঁদছেন মহিউদ্দিনের বাবা মোশাররফ হোসেন সরকার।

কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলায় মহিউদ্দিন ওরফে নাঈম সরকারের (২৮) বাড়িতে চলছে মাতম। ছেলেকে হারিয়ে আহাজারি করছেন বাবা। পাশেই মহিউদ্দিনের বোন মূর্ছা যাচ্ছেন। আজ বৃহস্পতিবার তোলা ছবি
প্রথম আলো

ছেলে মহিউদ্দিনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব সময় তিনি তাঁর ছেলেকে ন্যায়ের পথে থাকার কথা বলেছেন এবং ভালো কাজ করা শিখিয়েছেন। তাঁর ছেলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের গুলিতে মারা গেছেন। তিনি তাঁরা ছেলের খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।

নিহত সাংবাদিক মহিউদ্দিনের দীর্ঘদিনের বন্ধু স্থানীয় সাংবাদিক মাহফুজ বাবু বলেন, মহিউদ্দিন দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতা করছেন। সব সময় মাদক ও মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করেছেন। এসব কারণে মাদক ব্যবসায়ীরা তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন।

খোজঁ নিয়ে জানা গেছে, সাংবাদিক মহিউদ্দিন বেশ কয়েকবার পুলিশকে তথ্য দিয়ে বুড়িচং উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের শংকুচাইল এলাকার মাদক ব্যবসায়ী রাজু মিয়ার বিভিন্ন মাদকদ্রব্য জব্দ করতে সহায়তা করেছিলেন। এ নিয়ে রাজুর সঙ্গে মহিউদ্দিনের দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব রয়েছে।  গত ২৬ মার্চ মহিউদ্দিন পেশাগত কাজে সংকুচাইল যান। ওই সময় সংকুচাইল বাজারে পুলিশ মহিউদ্দিনের মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে। এ সময় তিনি পুলিশকে বলেন, ‘মাদক ব্যবসায়ীর মালামাল না ধরে আমাকে আটকালেন কেন।’

পরে মাদক ব্যবসায়ী রাজু এ কথা শোনার পর মহিউদ্দিনের সঙ্গে এ নিয়ে তাঁর বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে রাজু তাঁকে চড় মারেন। পরে মহিউদ্দিন রাজুকে গ্রেপ্তার এবং তাঁর মাদকদ্রব্য ধরিয়ে দিতে তৎপর হয়ে ওঠেন।

গত বুধবার স্থানীয় দুই ব্যক্তি মহিউদ্দিনকে ওই দিন রাতে রাজুর মাদকের চালান পাচার হবে বলে জানান।

সাংবাদিক মহিউদ্দিন সরকারের এক বন্ধু বলেন, গত বুধবার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে মহিউদ্দিন সরকার নাঈমকে ভারতীয় সীমান্তবর্তী কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের শংকুচাইলসংলগ্ন হায়দ্রাবাদ নগর এলাকায় ডেকে নেন জনৈক ব্যক্তি। এরপর মহিউদ্দিন রাতে সেখানে যান। এরপর মাদক কারবারিদের সঙ্গে তাঁর কথা–কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে মাদক কারবারি মো. রাজু ও মো. জুয়েল পিস্তল দিয়ে মহিউদ্দিনকে গুলি করেন। এ সময় তাঁদের আরও কয়েকজন সঙ্গী তাঁকে লোহার রড দিয়ে মারধর করে পালিয়ে যান।

পরে বিজিবির শংকুচাইল ক্যাম্পের সদস্যরা স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় তাঁকে বুড়িচং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেন। সেখানে নেওয়ার আগেই মহিউদ্দিন মারা যান। খবর পেয়ে বুড়িচং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যান কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান ও জেলা পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ।

এ বিষয়ে বিজিবির শংকুচাইল ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার নায়েব সুবেদার কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সাংবাদিক মহিউদ্দিন সীমান্ত এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। এ সময় স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে খবর পেয়ে বিজিবির সদস্যরা তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান।

নিহত সাংবাদিক মহিউদ্দিনের প্রতিবেশী আইনজীবী জাহাঙ্গীর আলম ভূইয়া বলেন, সাংবাদিক মহিউদ্দিন (মাঈন উদ্দিন সরকার) খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। এলাকার যেকোনো ভালো কাজে তাঁকে পাওয়া যেত।

ব্রাহ্মণপাড়া প্রেসক্লাবের সভাপতি সৈয়দ আহাম্মদ লাভলু বলেন, ‘সাংবাদিক মহিউদ্দিন মাদক ব্যবসায়ীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।’

বুড়িচং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর হোসেন বলেন, মাদক ব্যবসায়ীদের গুলিতে সাংবাদিক মহিউদ্দিন মারা গেছেন। সুরতহালে দেখা গেছে, তাঁর বুকে ছয়টি গুলি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে লাশে ময়নাতদন্তের জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। দুপুরে লাশ গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় থানায় হত্যা মামলার প্রস্তুতি চলছে। সাংবাদিক হত্যার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

জানতে চাইলে পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, নিহত মহিউদ্দিনের মা তিনজনের নাম উল্লেখ করে থানায় অভিযোগ দিয়েছেন। পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে। একই সঙ্গে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে।