‘মানুষ এখন কম কিনে, সব জিনিসের দাম বাড়ছে’

প্রায় ২২ বছর ধরে ভ্যানে সবজি বিক্রি করছেন নিপার হোসেন
ছবি: প্রথম আলো

ভোরের আবছা অন্ধকার থাকতেই দু-একটি করে ফাঁকা ভ্যান আসতে শুরু করেছে। সকালের আলো ফুটতে ফুটতে ভ্যানের সংখ্যা বেড়ে গেল। একটা ভ্যানের সঙ্গে আরেকটা ভ্যান লেগে আছে। পাশেই মৌলভীবাজার শহরের বেরিরপাড়ের সবজির আড়ত। মূলত ওই আড়তকে কেন্দ্র করেই ভ্যানের জমায়েত। দেশের নানা প্রান্ত থেকেই এই আড়তে সবজি আসে।

বেলা গড়ানোর সঙ্গে ভ্যানগুলো শাকসবজিতে ভরে ওঠে। আড়ত থেকে সামর্থ্যমতো বিক্রেতারা শাকসবজি কিনে এনে ভ্যানের ওপর সাজিয়ে রাখছেন। ক্রমেই নানা জাতের সবজিতে ভ্যানগুলো রঙিন হয়ে উঠল। শহরের বেরিরপাড়ের সবজির আড়তের পাশে প্রতিদিন সকালেই এমন দৃশ্যের দেখা মেলে।

ভ্যানের সবজি বিক্রেতারা জানালেন, এখন লাউ, পেঁপে, কুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, বেগুন, কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা, পুঁইশাক, কচু, পটল, বরবটি, করলা, ঢ্যাঁড়স, মুলা ইত্যাদি কমবেশি সারা বছরই পাওয়া যায়। তবে শীতের মৌসুমে সবজির বৈচিত্র্য আরও বেড়ে যায়। তখন মৌসুমি বিক্রেতার সংখ্যাও বাড়ে। শীতকালে আড়তের পাশে শতাধিক ভ্যান নিয়ে সবজি বিক্রেতার দল জড়ো হয়। তবে এখন প্রতিদিন অর্ধশত ভ্যান এখানে আসে। শাকসবজির পাশাপাশি ভ্যানে এখন আম, কাঁঠাল, লিচুসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফলও বিক্রি করতে দেখা যায়।

সবজির জোগান কম থাকলে বিক্রেতারা কিছুদিনের জন্য অন্য পেশায় যান। অনেকে আবার বাড়িতে চলে যান। বিক্রেতাদের অনেকেই ভ্যান ভাড়া নিয়ে আসেন। এ জন্য ভ্যানের মালিককে প্রতিদিন জমা দিতে হয় ৩০ টাকা। একটি ভ্যানে দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকার সবজি নেন একেকজন। যার যে রকম পুঁজি, ব্যবসাও সে রকম।

আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাতটার দিকে মো. নিপার হোসেন (৩৪) নামের এক সবজি বিক্রেতার সঙ্গে দেখা। বেচাকেনার অবস্থা জানতে চাইলে আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, ‘মানুষ এখন কম কিনে, সব জিনিসের দাম বাড়ছে। কী করব! মানুষের হাতে টাকাপয়সা কম। মানুষ মনে করেন, কোনো রকম কিনিয়া জান বাঁচায়।’

মৌলভীবাজার শহরের বেরিরপাড়ের সবজির আড়ত থেকে ভ্রাম্যমাণ সবজি ব্যবসায়ীরা সবজি সংগ্রহ করে শহরের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করেন
ছবি: প্রথম আলো

ক্রেতাদের বাজারের তালিকা সীমিত করে ফেলার বিষয়টি নিপারকেও ছুঁয়েছে। তিনি বলেন, ‘ভ্যানের সব মাল বেচতে পারা গেলে ভালো লাভ হয়। মোটামুটি চলা যায়। পাঁচ-ছয় মাস আগেও দিনের খাওয়াদাওয়া ৪০-৬০ টাকায় হইয়া যাইত। এখন একবারের নাশতাতেই লাগে ৪০ টাকা। ১০০-২০০ টাকার নিচে এক দিনের খাওয়া-থাকা হয় না।’

নিপার হোসেনের বাড়ি কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে। প্রায় ১২ বছর বয়স থেকে তিনি সবজির কারবারের সঙ্গে যুক্ত। তখন থেকে মৌলভীবাজারে মেসে থাকেন তিনি। শহরের অলিগলিতে ভ্যানে করে শাকসবজি বিক্রি করেন। সকালের আলো ফোটার আগেই তিনি মেস থেকে বের হন। এরপর আড়ত ঘুরে সবজি কেনেন। সবজি কেনা শেষে সেগুলো বিক্রির জন্য বেরিয়ে পড়েন। সবজি বিক্রি শেষ করতে কোনো দিন রাত ১০টাও বেজে যায়। নিপারের স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকেন। দুই-এক মাস পরপর বাড়িতে ঘুরে আসেন।

নিপার বলেন, ‘আজ ২ হাজার ৬০০ টাকার বিভিন্ন জাতের সবজি কিনেছি। এই সবজি বিক্রি করতে বিকেল তো হবেই, আবার রাতও হতে পারে। পুরো ভ্যান বিক্রি করতে পারলে ৪০০-৫০০ টাকা লাভ হবে। আগে মাসে বাড়িতে ৮-১০ হাজার টাকা পাঠাতে পারতাম। এখন কোনো ঠিক নাই। চার-পাঁচ হাজারও পাঠানো কঠিন। ঘরভাড়া, খাওনটাওন দিয়া কোনো রকম চলে।’

আলাপ শেষেই ভ্যান নিয়ে মৌলভীবাজার-শ্রীমঙ্গল সড়কের দিকে চলে গেলেন নিপার হোসেন। হুট করেই একটা গলির ভেতর ঢুকে গেল নিপারের ভ্যান। সবজির নাম ধরে হাঁক দিয়ে আরেকটি সংগ্রামের দিন শুরু করলেন।