মানুষের বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন বন্যার্তরা

বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি উদ্যোগেও অনেকে ত্রাণ দিচ্ছেন বন্যার্তদের মাঝে। সম্প্রতি সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায়ছবি: সংগৃহীত

মোহাম্মদআসলাম মিয়ার (৫৫) বাড়ি ঢাকার গেন্ডারিয়ায়। গত সোমবার তিনি একটি স্কুটি চালিয়ে সুনামগঞ্জেআসেন। পরিচিত একজনকে সঙ্গী করে এরপর তিনি ছুটে যান বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায়। খুঁজে খুঁজে বন্যায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত একটি গ্রামের ৮২টি পরিবারের হাতে অর্থ সহায়তা তুলে দেন। এরপর নীরবে ফিরে যান।

ভয়াবহ বন্যায় যখন সিলেট ও সুনামগঞ্জের মানুষেরা দিশেহারা, ঠিক তখনই তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন আসলাম মিয়ার মতো মানুষেরা। কেউ পাশে দাঁড়িয়েছেন নিজের উদ্যোগে, কেউ আবার নানা সংগঠনেরব্যানারে।

পূর্ণাঙ্গ হিসাব না থাকলেও সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের তথ্য বলছে, জেলার প্রায়তিন লাখ বন্যাকবলিত মানুষ বেসরকারি উদ্যোগে সহায়তা পেয়েছেন। আর সিলেটে জেলা প্রশাসনকেজানিয়ে বেসরকারি উদ্যোগে ২ কোটি ৮৫ লাখ ৬ হাজার টাকা এবং ৫১ হাজার প্যাকেট খাবার সহায়তাদেওয়া হয়েছে। দুই জেলার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির উদ্যোগেএর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি সহায়তা পেয়েছেন বন্যার্তরা।

এই ঘোর বিপদেএভাবে দেশে-বিদেশের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দাঁড়ানোর বিষয়টি বন্যার্ত মানুষকে আশাবাদীকরেছে বলে মনে করেন সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ পরিমল কান্তি দে। তিনি বলেন, ‘এটি সত্যিই আশার বিষয়। সুনামগঞ্জের মানুষ এ রকম সংকটে কখনো পড়েনি। এই বিপদে যেভাবেমানুষ পাশে দাঁড়িয়েছেন, সেটি আমাদের সাহস ও শক্তি সাহস জুগিয়েছে। এসব মানুষের হাত ধরেই বন্যায় চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা ঘুরে দাঁড়াবেন।’

গত ১৫ জুনবন্যা শুরুর পর থেকে সিলেট সাইক্লিং কমিউনিটি এবং সিলেট রানার্স কমিউনিটি নামের ফেসবুকভিত্তিকদুটি সংগঠন বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছে। এ সংগঠন দুটির অ্যাডমিন সাঈদসোহাগ জানান, গত মঙ্গলবার পর্যন্ত তাঁরা প্রায় সাড়ে চার হাজার মানুষের মধ্যে খাদ্যসহায়তাও পোশাক তুলে দিয়েছেন। কিছুদিন পর তাঁরা বন্যায় বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া বেশ কিছু ঘর নিজেদেরঅর্থায়নে মেরামতের কাজ শুরু করবেন। সুনামগঞ্জ শহরের বাসিন্দা তরুণ সমাজকর্মী মোহাম্মদ আম্মার বন্যার শুরু থেকেই মানুষকে উদ্ধার এবং সহায়তায় কাজ করছেন। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত তাঁর মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শতাধিকসংগঠন এসে মানুষকে খাদ্যসামগ্রীসহ নানাভাবে সহায়তা দিয়েছে। এসব সংগঠনের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী,তরুণ-যুবক।

বন্যার পানি ওঠা শুরু করলে ঘরে কোমরসমান পানিতে বন্দী হয়ে পড়েন সিলেট নগরের উপশহর এলাকার পঁচিশোর্ধ্ব এক নারী। তাঁর স্বামী প্রবাসী। ঘরে দুই মাসের শিশুটি বুকের দুধ খায় না। টানা কয় দিন পানিবন্দী থাকায় একসময় শিশুটির খাদ্যসংকট দেখা দেয়। মুঠোফোনে এ তথ্য পেয়ে সংস্কৃতিকর্মীরা ওই শিশুর জন্য গুঁড়া দুধ কিনে পৌঁছে দেন। সম্মিলিতনাট্য পরিষদ সিলেটের সভাপতি মিশফাক আহমদ চৌধুরী বলেন, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও ব্যক্তির অনুদানে তাঁরা ‘কলের গাড়ি’ নাম দিয়ে খাদ্যসহায়তা করছে। এ পর্যন্ত দুটি জেলায় প্রায় ৫০ লাখ টাকার খাদ্যসামগ্রী তাঁরা বিতরণ করেছেন।

চট্টগ্রামেরএকটি ট্রাস্ট সেখান থেকে সব কিছু নিয়ে এসে টানা এক সপ্তাহ সুনামগঞ্জের ৪০ হাজার মানুষের একবেলার খাবারের ব্যবস্থা করে। সুনামগঞ্জেরবাসিন্দা চিকিৎসক মো. নুরুল ইসলাম বলেন, তাঁরা বন্যার পরদিন থেকেই ত্রাণ তৎপরতা শুরুকরেছিলেন। এরপর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে থাকা তাঁর সহপাঠী, শুভাকাঙ্ক্ষী ও শুভানুধ্যায়ীরাএ পর্যন্ত তাঁর মাধ্যমে প্রায় ২৩ লাখ টাকার খাদ্যসামগ্রী, ওষুধ, পোশাকসহ নানাভাবে বন্যার্তমানুষকে সহায়তা দিয়েছেন।

সদর উপজেলারবল্লভপুর এলাকার বাসিন্দা হাফিজ ফেদাউর রহমান জানান, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আলেম-ওলামাযেমন নিজেরা এসেছেন, আবার তাঁদের মাধ্যমেও প্রায় সাত হাজার পরিবারকে এ পর্যন্ত সহায়তাদিয়েছেন। জেলা উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সংস্কৃতিকমীরাওএসেছেন দেশের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে। দিয়েছেন বন্যার্তদের সহায়তা।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তমানুষের পাশে সরকারের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নানাভাবে সহযোগিতা করছে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি,বিদ্যানন্দ, ব্র্যাক, গণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, আস–সুন্নাহ ফাউন্ডেশন, ইসলামিক রিলিফ,ভার্ডসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম, ক্রীড়া, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান।শুরুতে সরকারি-বেসরকারিএই ত্রাণ তৎপরতায় সমন্বয়ের অভাব ছিল। পরে প্রশাসন থেকে সেটি সমন্বয়ের উদ্যোগ নেওয়াহয়। তবে এখনো সেটি পুরোপুরি হয়ে ওঠেনি।

রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সুনামগঞ্জ ইউনিটেরসাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান পীর বলেন, এবার মানুষ যেভাবে সুনামগঞ্জের বন্যাদুর্গতদেরপাশে দাঁড়িয়েছে, এটি অব্যশই ইতিবাচক। তবে সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ তৎপরতায় আর সমন্বয়বাড়ালে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা উপকৃত হবেন।

সুনামগঞ্জেরজেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, শুরুতে পরিস্থিতির কারণেই এই কাজে সমন্বয় করাসম্ভব হয়নি। এখন প্রশাসনকে জানিয়েই বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ত্রাণ সহায়তা দিতেহচ্ছে। তারাই নির্ধারণ করে দিচ্ছে, কোথায় সহায়তা করবে।

সিলেটের একাধিকস্বেচ্ছাসেবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক,ক্রীড়া, রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন, উন্নয়নসংস্থা এবং নানা শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিও ইউটিউবাররা বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী বিতরণের কাজ করছেন। তাঁরা চাল, তেল, ডালসহবিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী, পোশাক, ওষুধ, শিশুখাদ্য, গোখাদ্য ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করছেন। টাকা বিতরণ থেকে শুরু করে ঘর পর্যন্ত নির্মাণ করে দিচ্ছেন কেউ কেউ। অনেকে বিনা মূল্যেচিকিৎসা শিবির করে ওষুধও বিতরণ করেছেন।

সাংস্কৃতিকসংগঠন সুবর্ণযাত্রার সভাপতি জাফর সাদেক শাকিল জানান, সুবর্ণযাত্রা ও শিশু-কিশোরদেরসংগঠন পাঠশালার যৌথ উদ্যোগে তাঁরা বন্যা শুরুর পর থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত প্রায় আট লাখটাকার খাদ্যসামগ্রী, শিশুখাদ্য এবং নগদ টাকা বিতরণ করেছেন। সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) ইয়াসমিন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, জেলা প্রশাসনকে অবহিতকরে সবাই যেহেতু ত্রাণ বিতরণ করছে না, তাই সঠিক পরিসংখ্যান জেলা প্রশাসনের কাছে নেই। তবে জেলা প্রশাসনকে জানিয়ে মঙ্গলবার পর্যন্ত বেসরকারিভাবে ২ কোটি ৮৫ লাখ ৬ হাজার নগদ টাকা এবং ৫১ হাজার প্যাকেট খাদ্যসহায়তা জেলার বিভিন্ন বন্যাকবলিত এলাকায় করা হয়েছে। এর বাইরেও অনেকে জেলা প্রশাসনকে অবহিত না করেও ত্রাণ দিয়েছে।