মারা গেলেন সড়কের পাশে কুড়িয়ে পাওয়া সেই বৃদ্ধা

দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃদ্ধা সুফিয়া খাতুন।ফাইল ছবি

ঠিক ছয় মাস পাঁচ দিন আগের কথা। অভাবের কারণে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে নবতিপর বৃদ্ধা সুফিয়া খাতুনকে ফেলে যান তাঁর স্বজনেরা। অসুস্থ সুফিয়াকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে উপজেলা প্রশাসন। চিকিৎসার পাশাপাশি তাঁর ভরণপোষণেরও ব্যবস্থা করে দেয়। কিন্তু স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তির ছয় মাসেও সুফিয়াকে তাঁর পরিবারের সদস্যরা কেউ নিতে আসেননি। এ ছাড়া স্বেচ্ছায় কেউ তাঁর দায়িত্ব নিতে চাইলে তার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তাতেও কেউ এগিয়ে আসেননি। অবশেষে সেই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই মারা গেলেন বয়সের ভারে অসহায় হয়ে পড়া সুফিয়া।

সুফিয়া খাতুন আজ রোববার ভোর ছয়টায় দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মারা গেছেন। দুপুর ১২টায় স্বজনেরা এসে সুফিয়া খাতুনের লাশ নিয়ে গেছেন।
সুফিয়া খাতুনের সঠিক বয়সটা কেউই বলতে পারেন না। তবে ১০০ বছরের কাছাকাছি বলে সবার অনুমান। ভিটেমাটি কিছু নেই। ছেলেমেয়ে দুজন। তাঁরাও বয়সের ভারে ন্যুব্জ। সংসার চলে কষ্টে। শেষে মাকে রাস্তায়ই ফেলে যান তাঁরা।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহীনূর আলম বলেন, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সুফিয়া খাতুন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন। তিনি শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। করোনা সংক্রমণকালে বৃদ্ধার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দীর্ঘ সময় ভর্তি থাকাটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। পরিবারের সদস্যরা তাঁকে ফিরিয়ে না নেওয়ায় নিরুপায় হয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই ভর্তি রাখতে হয়েছে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বৃদ্ধা সুফিয়া চোখে দেখতেন না। কানেও কম শুনতেন। তাঁকে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ফেলে যাওয়া হয়। প্রথমে তিনি কিছু বুঝে উঠতে পারেননি। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরও আপন কাউকে কাছে না পেয়ে চিৎকার শুরু করেন। খবর পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল ইসলাম খান ঘটনাস্থলে যান। তিনি সুফিয়াকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করান।
১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে উপজেলা প্রশাসন সুফিয়ার ছেলে মোখলেছুর রহমানের খোঁজ পায়। তাঁকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেকে এনে কথা বলে। তখন সুফিয়ার দুই সন্তানেরই পারিবারিক অসচ্ছলতার কথা জানতে পারে।

সুফিয়ার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, দাউদকান্দি পৌরসভার নছরুদ্দি গ্রামে সুফিয়ার বাড়ি। সুফিয়ার স্বামী কালাই মিয়া প্রায় ২০ বছর আগে মারা গেছেন। পরিবারটির এক শতক জমির ওপরে একটা বসতঘর ছাড়া কিছুই ছিল না। সেটিও এখন আর নেই। একমাত্র ছেলে মোখলেছুর রহমান বর্তমানে বয়োবৃদ্ধ। তিনি বসতভিটার নিজের অংশটি পাঁচ বছর আগে বিক্রি করে দেন একমাত্র বোন মিনা আক্তারের কাছে। এরপর থেকে মোখলেছুর রহমান বাস করেন মেয়ের শ্বশুরবাড়ি উপজেলার ষোলপাড়া গ্রামে।

মোখলেছুর রহমান বলেন, অভাব-অনটন দেখে নয় বছর আগে তাঁর স্ত্রী সৌদি আরবে চলে গেছেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন না। তিনি বাসে চানাচুর বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। থাকেন মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে। এমন পরিস্থিতিতে মাকে নিজের কাছে রাখা সম্ভব হয়নি।

বয়স হয়ে যাওয়ায় আমি নিজে কোনো কাজ করতে পারি না। আমার স্বামী আবদুল মান্নানও বৃদ্ধ। কোনো উপার্জন করতে পারেন না। এক ছেলের আয়ে কোনোমতে সংসার চলে। মাকে কীভাবে রাখব?
মিনা, সুফিয়া খাতুনের মেয়ে

একমাত্র মেয়ে মিনার কাছেই এত দিন ছিলেন সুফিয়া। সেই মেয়েও এখন বয়োবৃদ্ধ। তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন উপজেলার গঙ্গাপ্রসাদ গ্রামে। তিনি পৈতৃক ভিটা বিক্রি করে দিয়েছেন। দারিদ্র্যের কারণে তিনিই তাঁর মাকে মহাসড়কের পাশে ফেলে যান।
মিনা বলেন, ‘বয়স হয়ে যাওয়ায় আমি নিজে কোনো কাজ করতে পারি না। আমার স্বামী আবদুল মান্নানও বৃদ্ধ। কোনো উপার্জন করতে পারেন না। এক ছেলের আয়ে কোনোমতে সংসার চলে। মাকে কীভাবে রাখব?’

ইউএনও কামরুল ইসলাম খান বলেন, সুফিয়া খাতুনের ছেলে মোখলেছুর রহমানের তাঁর মায়ের দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সামর্থ্যের অভাবে নিতে পারেননি। আবার সুফিয়া খাতুনের কাছের অন্য কোনো আত্মীয়স্বজনও নেই। বৃদ্ধার দায়িত্ব নেওয়ার মতো বিশ্বস্ত লোক পাওয়া যায়নি।

ইউএনও আরও বলেন, করোনাকালে সুফিয়া খাতুনকে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা বৃদ্ধাশ্রম নিতে চায়নি। ঢাকার আগারগাঁও সরকারি বৃদ্ধাশ্রমে তাঁর জন্য কথা বলা হয়েছিল। তাঁকে বয়স্ক ভাতার কার্ড ও হুইলচেয়ার দেওয়া হয়েছিল। তা ছাড়া স্বেচ্ছায় কেউ তাঁর দায়িত্ব নিতে চাইলে তার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। স্বেচ্ছায় কেউ দায়িত্ব নিতে চাইলে তাঁকে এক লাখ টাকায় একটি ঘর নির্মাণ করে দেওয়াসহ অন্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেননি।

দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন বলেন, ভর্তির পর চিকিৎসায় সুফিয়া খাতুন শারীরিকভাবে সুস্থ হয়েছিলেন। কিন্তু স্বজনেরা নিয়ে না যাওয়ায় ছয় মাস পাঁচ দিন পর আজ রোববার ভোর ছয়টায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তিনি মারা গেছেন। পরে দুপুর ১২টায় স্বজনেরা সুফিয়ার লাশ নিয়ে গেছেন।

আরও পড়ুন