মির্জাগঞ্জে আজও প্লাবিত ২৮টি গ্রাম

বেড়িবাঁধের ওপর মাসুমা বেগম। পাশেই প্লাবিত বসতঘর। বৃহস্পতিবার দুপুরে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার রামপুর গ্রামেপ্রথম আলো

‘মোর হাঁস-মুরহা কিছুই বাঁচাইতে পারি নাই। সবই ভাইস্যা গ্যাছে পানিতে। তিনডা পোলা-মাইয়া লইয়া হারা রাইত কানছি আর আল্লা আল্লা হরছি। এহনও চতুর দিগে গলা হোমান পানি। কোনো দিগে যাইতেও পারি না।’ মির্জাগঞ্জ উপজেলার পূর্ব রামপুর গ্রামে পায়রা নদের বেড়িবাঁধের পাশে আজ শুক্রবার সকালে কথাগুলো বলছিলেন মাসুমা বেগম (৪৫)। সেখানেই তাঁর বাড়ি।

মাসুমার স্বামী ঢাকায় একটি মিলে দারোয়ানের চাকরি করেন। দুই ছেলে সাইফুল (২৪) ও তারেক (১৭), মেয়ে পপি (২২) আর শাশুড়িকে নিয়ে তাঁর সংসার। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের পূর্বাভাস আগে থেকেই জানতেন মাসুমা বেগম। কিন্তু কাছাকাছি কোনো আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় তাঁরা সবাই ঘরেই ছিলেন। সারা রাত নির্ঘুম কাটিয়েছেন তাঁরা। জোয়ারের পানিতে ঘরের নিচ থেকে মাটি ধসে গেছে। এখন কোনোরকমে ঘরটি দাঁড়িয়ে আছে। নদী ভাঙনে তিনবার বসতঘর ভেঙেছে তাঁদের। জমিজমা সবই গেছে নদীতে। বর্তমানে যেখানে বসবাস করছেন, সেখান থেকেও নদীর দূরত্ব কমতে কমতে এখন মাত্র ১০-১২ ফুট দূরে এসে ঠেকেছে। শেষ আশ্রয়স্থলটুকুও নদীতে বিলীন হয়ে যাবে যেকোনো সময়। সেটি এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

মাসুমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, তিন–তিনবার নদী ভাঙনে তাঁর ঘরবাড়ি নদীতে চলে গেছে। এ ঘরটুকুও গেলে আর  কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকবে না তাঁদের। ঘূর্ণিঝড় থেমে গেলেও ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে প্রতিদিন দুইবার প্লাবিত হচ্ছে তাঁর ঘরবাড়ি। এ ছাড়া পানিতে আশপাশের কাঁচা-পাকা সড়কগুলো সব সময় তিন-চার ফুট পানিতে তলিয়ে রয়েছে। নৌকা ছাড়া চলাচল করা সম্ভব হয় না।

রামপুর বেড়িবাঁধের অরক্ষিত ভাঙা অংশ দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে শুক্রবার রামপুর, সন্তোষপুর, আরজিদুর্গাপুর ও কাঁঠালতলী গ্রামের সহস্রাধিক বাড়িঘর প্লাবিত হয়েছে। পানি নেমে না যাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন মাসুমা বেগমের মতো এসব এলাকার বাসিন্দারা। মধ্য রামপুর গ্রামের কিরণ সরকার বলেন, গত কয়েক দিনের জলোচ্ছ্বাসে এলাকার কাঁচা-পাকা ঘর ও সড়ক বিধ্বস্ত হয়ে তছনছ হয়ে গেছে। মধ্যরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে কাজিরখালের গোড়া পর্যন্ত অন্তত ১০ স্থানে সড়ক ভেঙে শ্রীমন্ত নদের পানি প্রবেশ করছে।

রামপুর বেড়িবাঁধের অরক্ষিত ভাঙা অংশ দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে শুক্রবার রামপুর, সন্তোষপুর, আরজিদুর্গাপুর ও কাঁঠালতলী গ্রামের সহস্রাধিক বাড়িঘর প্লাবিত হয়েছে।

এদিকে মির্জাগঞ্জ, দেউলী সুবিদখালী, কাঁকড়াবুনিয়া ও মজিদবাড়িয়া ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পায়রা ও শ্রীমন্ত নদের জোয়ারের পানি প্রবেশ করে তিন দিন ধরে প্লাবিত হচ্ছে চর ছৈলাবুনিয়া, কলাগাছিয়া, সুন্দ্রা কালিকাপুর, পিঁপড়াখালী, মহিষাকাটার ঘোপের বাড়ি, কপালভেড়া, দক্ষিণ মির্জাগঞ্জ, চরকান্দা, চরখালী মেহেন্দীয়াবাদ, কুদবারচরসহ ২৮টি গ্রাম। তবে গত দুই দিনের তুলনায় পানির চাপ অনেকটাই কম জানান সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসী।

মাধবখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে বেড়িবাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে এলাকার যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এতে রামপুর, সন্তোষপুর, কাঁঠালতলী, কিসমত রামপুর, আরজি দুর্গাপুর গ্রামের বাসিন্দারা দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন।

পাউবো পটুয়াখালী কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালেহ আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে আজও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পায়রা নদের পানি প্রবাহিত হচ্ছে। তবে গত দুই দিনের তুলনায় কম। ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ মেরামতের কাজ ইতিমধ্যেই শুরু করা হয়েছে। মির্জাগঞ্জ উপজেলার মাধবখালী ইউনিয়নের রামপুর অরক্ষিত সাড়ে ৪০০ ফুট বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। বেড়িবাঁধ বারবার নদীতে চলে যাওয়ায় নতুন স্থান নির্ধারণে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ করে খুব শিগগিরই বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোসা. তানিয়া ফেরদৌস বলেন, ঘূর্ণিঝড় থেমে গেলেও ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে অনেক গ্রাম আজও প্লাবিত হয়েছে। ভাঙা বেড়িবাঁধ মেরামতের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বন্যায় দুর্গত ৯০০ পরিবারকে ইতিমধ্যে খাদ্যসহায়তা দেওয়া হয়েছে।