মুঠোফোনে পরিচয়-প্রেম-বিয়ে, এখন স্বামী তাঁকে চেনেন না

তিন বছর আগে মুঠোফোনের কল থেকে এক তরুণের সঙ্গে পরিচয় হয় তরুণীর। পরিচয় থেকে প্রেম। পরিচয়ের এক বছর পর তরুণী দেখা করেন তরুণের সঙ্গে। তাঁরা বিয়ে করেন। ঘর ভাড়া করে সংসারও শুরু করেন। তরুণীর বাবার বাড়িতে গিয়ে স্বামী হিসেবে বেড়িয়েও আসেন তরুণ। হঠাৎ করেই সেই তরুণ লাপাত্তা।


তরুণীর অভিযোগ, মাস দুয়েক আগে স্বামীর খোঁজ পান তিনি। জমিতে ঘর তোলার জন্য তাঁকে বাবার বাড়ি থেকে এক লাখ টাকা এনে দিতে বলেন স্বামী। সেই টাকা হাতিয়ে নিয়ে এখন তাঁকে স্ত্রী বলে মানতে রাজি নন স্বামী। স্বামীর যে স্ত্রী ও সন্তান আছে, সেটাও জানতেন না তরুণী।

ঘটনাটি ঘটেছে জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলায়। তরুণের নাম সুরুজ মিয়া (২৫)। বাড়ি দুপচাঁচিয়া উপজেলার জোয়ালমাঠা গ্রামে। তবে তিনি বড় হয়েছেন নানার বাড়ি আক্কেলপুর উপজেলার চাপাগাছি হরিপুর গ্রামে। আর তরুণী (২০) কিশোরগঞ্জ জেলার। বাবা মোরব্বা ব্যবসায়ী। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তরুণীই বড়।

প্রতারণার ঘটনাটি জানিয়ে গত শনিবার পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন ওই তরুণী। স্বামীর খোঁজে কিশোরগঞ্জ থেকে আক্কেলপুরে এসে তিনি বিপাকে পড়েছেন। তিনি এখন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নারী সদস্যের আশ্রয়ে আছেন। পুলিশ তরুণীকে বাড়ি ফিরে যেতে বলেছেন। কিন্তু টাকা ছাড়া ফেরত গেলে তাঁকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন তিনি।


মেয়েটি জানান, কিশোরগঞ্জের বাড়িতে থাকার সময় তিন বছর আগে তাঁর মুঠোফোনে অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসে। নম্বরটি ছিল সুরুজ মিয়ার। মুঠোফোনে তাঁদের পরিচয় হয়। তাঁদের নিয়মিত কথা হতো। একপর্যায়ে তাঁদের মধ্যে প্রেমের সর্ম্পক গড়ে ওঠে। তিনি তাঁর প্রেমিকের নাম–ঠিকানা নেন। ঠিকানা অনুযায়ী তিনি দুই বছর আগে ঢাকার সাভারে গ্যারেজ এলাকায় সুরুজ মিয়ার কাছে চলে আসেন। সেখানে সুরুজ মিয়া একটি রিকশার গ্যারেজে কাজ করতেন। তাঁরা দুজন বিয়ে করে গ্যারেজ এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করছিলেন।

তরুণী জানান, তাঁকে কখনো সুরুজ মিয়া নিজের গ্রামে নিয়ে যাননি বা পরিবারের কারও সঙ্গে পরিচয় করাননি। একবার আক্কেলপুরে নিয়ে গেলেও স্ত্রীকে তোলেন এক বন্ধুর বাসায়। স্বামীর বাড়ি কোন গ্রামে, সেটিও তিনি জানতেন না। তবে মেয়েটি এবার ঈদুল ফিতরে তাঁর গ্রামের বাড়িতে স্বামীকে নিয়ে বেড়াতে যান। পরিবারের সবাই বিয়েটা মেনে নেন। তবে ঈদের পর তাঁকে বাবার বাড়িতে রেখে সুরুজ মিয়া হুট করেই চলে যান। এরপর থেকে সুরুজকে আর মুঠোফোনে পাচ্ছিলেন না তিনি। পরে গত জুলাই মাসে সুরুজকে মুঠোফোনে পান তিনি। সুরুজ তাঁকে জানান, বাড়িতে কেউ তাঁকে মেনে নেবেন না। এ কারণে বাড়ি করার জন্য জায়গা কিনতে হবে। বাড়ির জায়গা কেনার জন্য এক লাখ টাকা চান। সুরুজ মিয়া তাঁকে মুঠোফোনে জায়গার মালিকের সঙ্গে কথাও বলিয়ে দেন।

মেয়েটি স্বামীর কথায় বিশ্বাস করে প্রথমে বিকাশ নম্বরে ২০ হাজার টাকা দেন। গত ৭ আগস্ট তিনি বাবার বাড়ি থেকে আরও ৮০ হাজার টাকা নিয়ে নিয়ে স্বামীর কথামতো জয়পুরহাটের দুপচাঁচিয়া উপজেলায় আসেন। সেখানে স্বামী তাঁকে মর্তুজাপুর গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে তোলেন। তিনি কে প্রতিবেশীরা সেই প্রশ্ন তোলায় ৯ আগস্ট তাঁকে নিয়ে সাভারে ভাড়া বাসায় চলে আসেন সুরুজ মিয়া। সঙ্গে ছিলেন বন্ধু সম্রাট ও লিটন। ওই সময়ও তিনি জানতেন না, স্বামীর আগে থেকেই স্ত্রী ও সন্তান আছে।


এরপর সাভারের ভাড়া বাসায় তরুণীকে একা রেখেই আক্কেলপুর উপজেলায় ফিরে আসেন সুরুজ মিয়া। পরে তরুণী মুঠোফোনে সুরুজের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁকে আক্কেলপুরের গোপীনাথপুর ইউনিয়নে আসতে বলেন সুরুজ। এরপর তিনি শুক্রবার রাত নয়টার দিকে গোপীনাথপুরের কড়ইতলা এলাকায় বাস থেকে নামেন। সেখানে তাঁর স্বামী সুরুজ মিয়া, সম্রাট ও লিটন থাকার কথা ছিল। কিন্তু বাস থেকে নামার পর তাঁদের কাউকে সেখানে দেখতে পাননি তিনি। মুঠোফোনে সুরুজের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর তিনি সম্রাটের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। রাতে তরুণীকে এভাবে দিগ্‌ভ্রান্ত অবস্থায় দেখে টহল পুলিশ তাঁকে সেখান থেকে নিয়ে গোপীনাথপুর ইউপির সংরক্ষিত ওয়ার্ডের মহিলা সদস্য হেলেনা বেওয়ার বাড়িতে নিয়ে যান।

এদিকে মেয়েটিকে আশ্রয় দেওয়ায় সুরুজ মিয়া ও তাঁর সহযোগীরা ইউপি সদস্য হেলানা বেওয়াকে গালিগালাজ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এখন তিনিও মেয়েটিকে তাঁর কাছে রাখতে চাইছেন না। বাড়ি করার জন্য জায়গা কেনা বাবদ স্বামীকে দেওয়া এক লাখ টাকা ফেরত না পেলে তরুণীকে বাড়ি ফিরতে মানা করেছেন বাড়ির লোকজন। তাই তিনি এখন কোথায় যাবেন, এ নিয়ে দিশেহারা বোধ করছেন।


তরুণী এই প্রতিবেদককে কাঁদতে কাঁদতে জানান, শনিবার থানায় একটি অভিযোগ দিয়েছেন। পরদিন রোববার থানার একজন উপপরিদর্শক (এসআই) এসে তাঁর সঙ্গে কথা বলে চলে যান। এরপর তাঁর স্বামী ও তাঁর বন্ধুরা ইউপি সদস্যের বাড়িতে এসে তাঁকে গালিগলাজ করে যান। তিনি বলেন, ‘তিনি (সুরুজ) আমাকে স্ত্রী হিসেবে স্বীকার করছেন না। তাঁকে দেওয়া টাকা ফেরত না পেলে বাবার বাড়িও যেতে পারছি না। আমার জন্য ইউপি সদস্য হেলেনা বেওয়া অপদস্ত হচ্ছেন। থানা–পুলিশও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আমি এখন কী করব?’

ইউপি সদস্য হেলেনা বেওয়া গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, সুরুজের স্ত্রী-সন্তান রয়েছে, এটাও মেয়েটি জানতেন না। সুরুজ মেয়েটিকে স্ত্রী হিসেবে স্বীকারও করছেন না। যেন চেনেনই না। রাতে মেয়েটি কোথাও যেতে পারছিলেন না বলে টহল পুলিশ তাঁর জিম্মায় দিয়ে গেছে। তিন দিন ধরে তাঁর বাড়িতে আছেন। তিনি বলেন, ‘মেয়েটিকে আশ্রয় দেওয়ায় সুরুজ, সম্রাট ও লিটন বাড়িতে এসে আমাকে গালিগলাজ করেছেন। আমি আর মেয়েটিকে রাখতে চাইছি না। আজ (সোমবার) মেয়েটিকে নিয়ে থানায় গিয়ে ওসির সঙ্গে দেখা করেছি। ওসিসাহেব মেয়েটিকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে বলেছেন।’


অভিযোগের ব্যাপারে সুরুজ মিয়া ও সম্রাটের এলাকায় গিয়ে খোঁজ করে তাঁদের পাওয়া যায়নি। তাঁদের মুঠোফোনও বন্ধ রয়েছে।


পুলিশ জানিয়েছে, সাভারে কোন কাজি বিয়ে পড়িয়েছেন, সেটাও মেয়েটি বলতে পারেননি। তাঁর কাছে বিয়ের কাবিননামাও নেই।


আক্কেলপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল লতিফ খান বলেন, ‘মেয়েটির অভিযোগটি তদন্ত করা হচ্ছে। যেহেতু এখানে তাঁর কেউ নেই, তাই তাঁকে বাবার বাড়িতে চলে যেতে বলেছি।’