মুশতারী শফীকে শেষ শ্রদ্ধা চট্টগ্রামবাসীর

আজ বুধবার চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফীর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান সর্বস্তরের মানুষ
ছবি: জুয়েল শীল

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফীর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক বেগম মুশতারী শফীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আজ বুধবার সকালে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আসেন মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ, সংস্কৃতিকর্মী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

শ্রদ্ধা জানানোর ফাঁকে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এই শহীদজায়াকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।

শোক ও শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে বিভিন্ন বক্তারা মুশতারী শফীর কর্মময় সংগ্রামী জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।

বক্তারা বলেন, ব্যক্তিজীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে মুশতারী শফীর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, ‘আজ অত্যন্ত শোকের দিন। শহীদজায়া ও ভগ্নিকে আমরা হারিয়েছি। তিনি পুরো একটি সংগ্রামী জীবন কাটিয়েছেন। মুশতারী শফী বান্ধবী নামে সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। পরে তিনি বের করেন বান্ধবী নামের পত্রিকা। ওই পত্রিকার প্রত্যকে কর্মী, এমনকি মেশিনম্যান পর্যন্ত ছিলেন নারী। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শুরুর বৈঠকগুলো তাঁদের বাড়িতে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে তিনি স্বামী ও ভাইকে হারিয়েছেন।’

আবুল মোমেন আরও বলেন, ওই অবস্থায় মুশতারী শফী ভারতে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ভূমিকা পালন করেন। ফিরে এসে দেখেন, পুরো বাড়ি লুণ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু তিনি নিঃশেষিত হননি। সামাজিক-সাংস্কৃতিক-নাগরিক আন্দোলনে যুক্ত হন তিনি। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। তিনি আজীবন সংগ্রামী অভিভাবক হয়ে ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি থাকবেন সবার বিশ্বাসে, চেতনায়।

মুক্তিযোদ্ধা বালাগাত উল্লাহ শোক জানাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি স্মৃতিচারণা করে বলেন, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুশতারী শফীর স্বামী ও ভাইকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তিনি মিরসরাইয়ে কিছুদিন থেকে ভারতে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারের সঙ্গে যুক্ত হন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিরীণ আখতার বলেন, ‘শহীদজায়া, শব্দসৈনিক মুশতারী শফীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। একাত্তরে তাঁর চোখের সামনে স্বামী ও ভাইকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তাঁর প্রেসটি ধ্বংস করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পরও তিনি আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতো মানুষকে আজ বড় প্রয়োজন ছিল। তিনি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন।’

সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, মুশতারী শফীকে সব আন্দোলন-সংগ্রামে চট্টগ্রামের মানুষ কাছে পেয়েছে। শহীদ মিনারে আজ মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করে, তিনি চট্টগ্রামের মানুষের হৃদয়ে ছিলেন।

শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফীকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়
ছবি: জুয়েল শীল

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে আইনজীবী শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বলেন, ‘জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যখন গোলাম আজমসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে উত্তাল হলো দেশ, তখন মুশতারী শফীর নেতৃত্বে চট্টগ্রামে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম। লালদিঘির মাঠে গোলাম আজমকে প্রতিরোধ করার মিছিলে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই মুক্তিযোদ্ধা।’

সিপিবির সাধারণ সম্পাদক অশোক সাহা বলেন, ‘মুশতারী শফী ৫০ বছর ধরে অসম সাহসের সঙ্গে লড়েছেন একটি প্রগতির বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য। তিনি ছিলেন এক লড়াকু মানুষ। প্রগতি, শোষণমুক্তি ও ন্যায়ের সংগ্রাম শাণিত হলে মুশতারী শফীকে সেখানে খুঁজে পাব আমরা।’

স্মৃতিচারণা করে ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের তপন দত্ত বলেন, ‘একাত্তরে মুশতারী শফীর বাড়িতে আমরা অস্ত্র রেখেছিলাম। এর জন্য তাঁর স্বামী ও ভাইকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।’

উদীচী চট্টগ্রামের সংগঠক শীলা দাশগুপ্ত ও সাংবাদিক রমেন দাশগুপ্তের সঞ্চালনায় শোক জানান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য বেণু কুমার দে, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মোজাফফর আহমদ, মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমান, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার, সাংবাদিক ওমর কায়সার, প্রমা আবৃত্তি সংসদের সভাপতি রাশেদ হাসান, শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম প্রমুখ।

শোকসংগীত পরিবেশন করেন উদীচী চট্টগ্রামের শিল্পীরা।

বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ বেগম মুশতারী শফীর প্রতি শ্রদ্ধা জানান
ছবি: প্রথম আলো

সকাল পৌনে ১০টার দিকে মুশতারী শফীর কফিন বহনকারী গাড়ি শহীদ মিনারে পৌঁছায়। সেখানে আগে থেকেই বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত হন।

নগর আওয়ামী লীগ, কোতোয়ালি আসনের সাংসদ ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী, সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলমের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে মুশতারী শফীর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।

সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, প্রজন্ম ৭১, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, ওডিসি, সনাক, খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগর, ন্যাপ, জাসদ মার্ক্সবাদী, গণমুক্তি ইউনিয়ন, বাসদ, সিআরবি রক্ষা মঞ্চ, নাগরিক সমাজ চট্টগ্রাম, শিল্পকলা একাডেমি, খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরী কমিটি, নারী যোগাযোগ কেন্দ্র, যুব ইউনিয়ন, ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বোধন আবৃত্তি পরিষদ, প্রমা আবৃত্তি সংগঠন, ফুলকি স্কুল, বিটা, এনায়েত বাজার মহিলা কলেজ, বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সংসদ কমান্ডসহ বিভিন্ন সংগঠন ফুল দিয়ে মুশতারী শফীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আ স ম জামশেদ খন্দকারের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (দক্ষিণ) আমিনুল ইসলামের উপস্থিতিতে পুলিশের একটি দল মুশতারী শফীকে গার্ড অব অনার প্রদান করে।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন মুশতারী শফীর জামাতা লে. কর্নেল (অব.) সাংসদ নজরুল ইসলাম।

মুশতারী শফীর মেয়ে রুমানা শফী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমার মা সারা জীবন যুদ্ধ করেছেন। তিনি সব সময় সমাজের অসহায়-গরিব-দুঃখী নারীদের পাশে ছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তিনি অন্যতম সংগঠক। আমরা সন্তানেরা শুধু না, চট্টগ্রামের লাখো সন্তান মা হারালেন।’

গত সোমবার বিকেলে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) মৃত্যু হয় শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফীর। ৮৪ বছর বয়সী মুশতারী শফী কিডনি, রক্তে সংক্রমণসহ নানা জটিলতায় ভুগছিলেন।

গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মুশতারী শফীর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান সর্বস্তরের মানুষ। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে মুশতারী শফীর জানাজা হয়।

ঢাকায় শ্রদ্ধা নিবেদন ও জানাজার পর গতকাল বেলা দুইটার দিকে মুশতারী শফীর মরদেহ নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হন তাঁর পরিবারের সদস্যরা।

আজ দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের জমিয়তুল ফালাহ মসজিদে জানাজা শেষে চৈতন্য গলির কবরস্থানে মুশতারী শফীকে দাফন করা হবে।