মৃৎশিল্পের দুর্দিনেও তাঁরা হাল ছাড়েননি

মাটির তৈরি বিভিন্ন পণ্য। গত শুক্রবার মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার নন্দীউড়ায়
ছবি: প্রথম আলো

গ্রামের ১৮টি পরিবারের মধ্যে ২-৩টি বাদে সব পরিবারই মাটির তৈজসপত্র তৈরি ও এ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল। সে সময় কোনো উৎসব-পার্বণই মাটির পাত্র ছাড়া চলেনি। মৃৎশিল্পের সে এক রমরমা সময় গেছে। বিভিন্ন কারণে এখন আর সেই অবস্থা নেই। তাই এ ব্যবসার সঙ্গে অত পরিবারও জড়িত নেই।

তবে মাটির পণ্যের নানা রকম চাহিদা এখনো ফুরিয়ে যায়নি। মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার রাজনগর সদর ইউনিয়নের নন্দীউড়া গ্রামের কিছু পরিবারের সদস্যরা পারিবারিক ব্যবসা হিসেবে সেই ঐতিহ্যের ধারাটিকে আঁকড়ে আছেন। কিন্তু মাটি, জ্বালানি কাঠ ও পুঁজির সংকটে তাঁরা টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছেন।

মৃৎশিল্পী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, তিন দশক আগেও মৌলভীবাজার অঞ্চলে মাটির তৈরির তৈজসপত্রের অনেক চাহিদা ছিল। শিরনি, পূজা-পার্বণ, বিয়েতে প্রয়োজন পড়ত মাটির তৈরি রিপাইক (মাটির প্লেট), হাঁড়ি, দইয়ের পাতিলসহ বিভিন্ন ধরনের জিনিসের। যাঁদের প্রয়োজন, তাঁরা আগেভাগেই যোগাযোগ করে চাহিদা জানাতেন। নির্ধারিত সময়েই নির্দিষ্ট স্থানে তা পৌঁছানো হতো। এগুলো ছিল পরিবেশবান্ধব। ভেঙেচুরে তা আবার মাটির সঙ্গেই মিশে গেছে।

বৈশাখে বারুণী মেলাকে কেন্দ্র করেও মৌসুমি ব্যবসা ছিল। চৈত্র মাসে চাক (মাটির তৈজসপত্র তৈরির যন্ত্র) ঘুরেছে আর মাটির একেকটি দলা আকার নিয়েছে কলস, হাঁড়ি, সরাসহ নানা রকম তৈজসপত্রের। হাতে হাতে তৈরি হয়েছে হাতি-ঘোড়া, নানা জাতের পাখি, মাটির ব্যাংক, ফলসহ অনেক রকম খেলনা। তাতে হাত লাগিয়েছেন ঘরের নারীরাও। সেগুলো তুলির আঁচড়ে রঙিন, নজরকাড়া করে তুলেছেন প্রতিটি পণ্যকে। এরপর এ পণ্য বিক্রির জন্য বাড়ির পুরুষেরা নিয়ে গেছেন এলাকার বিভিন্ন বারুণী মেলায়, বিভিন্ন হাটবাজারে। পাইকাররা এসেও বাড়ি থেকে নিয়ে গেছেন পণ্যসামগ্রী। তবে তা আর আগের মতো নেই। অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকপণ্য মাটির তৈজসপত্রের স্থানটি দখলে নিয়েছে। তারপরও মৃৎশিল্পের চাহিদা এখনো শেষ হয়ে যায়নি।

নন্দীউড়ার মৃৎশিল্পীদের সূত্রে জানা গেছে, তাঁদের গ্রামে এ পেশার ১৮টি ঘর ছিল। এর মধ্যে দু-তিনটি ঘর বাদে বাকি সবাই এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল। এখন মৃৎশিল্পের কাজের সঙ্গে যুক্ত আছে তিনটি পরিবার। মুক্তিযুদ্ধের পর কিছু পরিবার গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে।

প্রবীণ মৃৎশিল্পী হরেন্দ্র পাল গত শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন মাটির সমস্যা, জ্বালানি কাঠের সমস্যা, আগের মতো কারবারও নাই। এ কারণে অনেকে আর এসব করতে পারেন না। পরবর্তী সময়ে আমাদের এখানে এ ব্যবসা থাকবে কি না, বোঝরাম না।’

হরেন্দ্র পালসহ অন্যরা জানিয়েছেন, মাটির তৈজসপত্র তৈরির জন্য প্রয়োজন হয় আঠালো ধরনের মাটি। আগে মাটির স্থান চিহ্নিত করা হয়, তারপর গর্ত করে জমির ৮ থেকে ১০ হাত নিচ থেকে এ মাটি সংগ্রহ করতে হয়। আগে জমির মালিককে টাকা দিতে হতো না। এখন মাটি আগের মতো পাওয়া যায় না। গর্ত করতে হয় বলে অনেকেই জমি থেকে মাটি দিতে চায় না। দিলেও ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা দিতে হয়। শুকনা মৌসুমে মাটি সংগ্রহ করা লাগে। তারপর সারা বছর কাজ চলে। এ ছাড়া জ্বালানি কাঠও আগে কিনতে হয়নি। এখন এক মণ জ্বালানি কাঠ কিনতে লাগে ১৫০ টাকা।

মৃৎশিল্পী উপেন্দ্র পাল বলেন, ‘আগে সবকিছু ফ্রিতে মিলত। এখন মাটি, লাকড়ি—সবকিছু কিনা (ক্রয়) লাগে। টাকা দিয়ে পোষাতে পারি না। আর্থিক সহযোগিতা পাইলে ব্যবসাকে বাড়ানো যাইত।’ তিনি জানান, তাঁদের তৈরি আকার অনুযায়ী একটি কলস ৫০ থেকে ১০০ টাকা, পাতিল ১২ থেকে ২০ টাকা, সরা ১০ থেকে ২০ টাকায় বিক্রি করেন। এ ছাড়া পূজা-পার্বণের জন্য বিভিন্ন মাটির জিনিস ও রাবারের কষ সংগ্রহের জন্য বাটি তৈরি করেন তাঁরা। সপ্তাহে দুদিন স্থানীয় ট্যাংরা বাজার ও মুন্সিবাজারে মাটির তৈরি জিনিস বিক্রির জন্য নিয়ে যান। বৈশাখে বারুণী মেলায়ও তৈজসপত্রসহ বিভিন্ন খেলনা বিক্রি করেন। দুই-এক মাস পরপর পাইকার এসেও নিয়ে যান।

গত শুক্রবার নন্দীউড়ায় উপেন্দ্র পালের ঘরে দেখা গেছে, বিক্রির জন্য কলস, হাঁড়ি-পাতিল, সরা, মাটির ব্যাংক ইত্যাদি তৈরি করে রাখা হয়েছে। বাড়ির একটি স্থানের চুলা থেকে কাঁচা তৈজসপত্র পোড়ানোর গন্ধ তখনো ভেসে বেড়াচ্ছে।

রুমেন পাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মালের চাহিদা আছে। অনেকে আবার মাটির জিনিসপত্র ব্যবহার করছে। প্লাস্টিকের জিনিসের মধ্যে খাইতে পারে না। কিন্তু মাটি, জ্বালানি সংকট ও আর্থিক কারণে বানানো যাচ্ছে না। তারপরও পারিবারিক ব্যবসা ও ঐতিহ্য হিসেবে এখনো এটারে ধরে রাখছি।’

রাজনগরের ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বাবলু সূত্রধর বলেন, ‘আমি মাত্র কয়েক দিন হলো দায়িত্ব নিয়েছি। মৃৎশিল্পী কিছু পরিবার আছে জানি, কিন্তু তাদের তো চিনি না। এ শিল্প বিলুপ্তই প্রায়। তাদের আর্থিক সহযোগিতার কিছু সুযোগ আছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে দেখব, কীভাবে সহযোগিতা করা যায়।’