মেঘনার বাঁধের মুখ থেকে কৃষিজমির মাটি ইটভাটায়, হুমকিতে লোকালয়

মেঘনার তীর-সংরক্ষণ বাঁধের তীরে কৃষিজমির মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়। এতে ভাঙনের মুখে পড়েছে হাকিমুদ্দিন বাজার। গত রোববার তোলা ছবিপ্রথম আলো

দালালপুর মৌজার পুবের বিলে প্রায় ২০ একর কৃষিজমি। এ জমির উত্তর-পূর্বে মেঘনা নদী। কাউকে না জানিয়ে অনেকটা জোর করে ফসলি জমির মাটি কেটে নিচ্ছেন ইটভাটার মালিক। গভীর গর্ত করে খননের কারণে পাশের জমিও ভেঙে পড়ে। সেই জমির মাটিও কেটে নিচ্ছেন। এভাবে আস্তে আস্তে বিলের সব জমি ইটভাটার পেটে যাচ্ছে। আর সেখানে হামলে পড়ছে পাশের মেঘনা নদীর জোয়ার। জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসে তীর-সংরক্ষণ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। ভেঙে যাচ্ছে কয়েক শ কোটি টাকার তীর সংরক্ষণ ব্লক বাঁধ।

কথাগুলো বলেন ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার টবগী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মো. নুরুল ইসলাম (৮০)। তিনি জানান, তাঁর নিজের ৭২ শতাংশ ফসলি জমির মাটি জোর করে নিয়ে গেছেন ইটভাটার লোকজন।

বোরহানউদ্দিন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ওমর ফারুকের ভাষ্য, দালালপুর মৌজার প্রায় তিন একর কৃষিজমি ইটভাটার কবলে চলে গেছে। তবে স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, কমপক্ষে ১২ একর কৃষিজমির মাটি ইটভাটায় গেছে।

মেঘনার তীর-সংরক্ষণ বাঁধের তীরে কৃষিজমির মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়। গত রোববার তোলা ছবি
প্রথম আলো

বোরহানউদ্দিন উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপসহকারী প্রকৌশলী হুমায়ূন কবীর বলেন, ইটভাটার মালিকদের মৌখিকভাবে অনেকবার সতর্ক করেছেন। নদীর তীরবর্তী ৫০ মিটারের (১৭০ ফুট) মধ্যে খননকাজ করা তীর-সংরক্ষণ বাঁধের জন্য চরম ঝুঁকির। ব্লক বাঁধের ভেতরে যদি কারও রেকর্ডীয় জমিও থাকে, তা–ও খনন করার নিয়ম নেই। তারপরও ভাটার মালিকেরা নিষেধ শোনেননি। এতে পাউবোর কয়েক কোটি টাকার ব্লক বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ভোলা-১ পাউবো সূত্র জানায়, কয়েক শ বছরের পুরোনো ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার হাকিমুদ্দিন বাজার। এই বাজারকে কেন্দ্র করে ওই এলাকার (হাসাননগর ও টবগী ইউনিয়ন) শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি বিকাশ হয়েছে। এই বাজার, শাহবাজপুর গ্যাস ফিল্ডসহ বোরহানউদ্দিন উপজেলাকে রক্ষা করতে দুই দফায় পাউবো প্রায় ৩০০ কোটি টাকা খরচ করে ৮ দশমিক ৭৮৫ কিলোমিটার দীর্ঘ মেঘনার তীর সংরক্ষণ ব্লক বাঁধ নির্মাণ করেছে। সেই ব্লক বাঁধের প্রায় দুই কিলোমিটার এখন মেঘনায় বিলীন হচ্ছে।

গত রোববার সরেজমিন দেখা যায়, উপজেলার উদয়পুর রাস্তার মাথা বাজার থেকে জনাকীর্ণ এলাকায় একের পর এক ইটভাটা ছড়িয়ে আছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে উপজেলার টবগী ও হাসাননগর ইউনিয়ন দুটিতে রয়েছে ৯টি ইটভাটা। এই দুটি ইউনিয়ন সব থেকে বেশি ভাঙনকবলিত ও গুরুত্বপূর্ণ। টবগীতে শাহাবাজপুর গ্যাস ফিল্ডের একটি কূপ অবস্থিত। এ ছাড়া ইউনিয়ন দুটির সর্বত্র ছড়িয়ে আছে পকেট-গ্যাস। গভীর নলকূপ বসিয়ে মানুষ বিনা মূল্যে, বিনা কষ্টে পানি ও গ্যাস পাচ্ছে।

দেখা যায়, মেঘনাতীরের বোরহানউদ্দিনের ভাঙন পরিস্থিতি ভয়াবহ ও করুণ। পাউবোর হিসাবে ১৯৭২ সাল থেকে গত ৪৮ বছরে প্রায় ৭ কিলোমিটার এলাকা ভেঙেছে। হাসাননগরের যৎসামান্যই টিকে আছে। বাঁদ নির্মাণ করে ভাঙন থমকে গেলেও নতুন করে হুমকির মুখে পড়েছে হাকিমুদ্দিন বাজার। এ বাজারের মধ্যে রয়েছে শতবর্ষী হাকিমুদ্দিন ফাজিল মাদ্রাসা, হাকিমুদ্দিন আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, লঞ্চঘাট, কয়েক শ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, প্রায় দুই হাজার মানুষের বসতঘর, এলজিইডি, সওজের সড়কসহ বহু স্থাপনা।

মেঘনার তীর-সংরক্ষণ বাঁধের তীর এলাকার মাটি তুলে ইটভাটায় নেওয়ায় ডুবে যাচ্ছে কৃষিজমি। গত রোববার তোলা ছবি
প্রথম আলো

হাকিমুদ্দিন বাজারের মধ্যে মেঘনা নদী থেকে বেরিয়ে এসেছে বেতুয়া খাল। ইটভাটার মালিকেরা জোর করে এ খালের মাটিও কেটে নিচ্ছেন। পশ্চিমে টবগী ইউনিয়নের দালালপুর মৌজায় রয়েছে জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এবং উত্তর-পূর্ব-দক্ষিণে হাসাননগরে রয়েছে মেঘনার তীর সংরক্ষণ বাঁধ। মাঝখানে পুবের বিলের কৃষিজমি ও হাকিমুদ্দিন বাজার এলাকা। বিলের মধ্যে গর্ত ও পুকুর। জোয়ারের পানি ঢুকে সেটি এখন খরস্রোতা খালে পরিণত হয়েছে।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, কৃষিজমিতে খাল সৃষ্টির কারণে তীর সংরক্ষণ ব্লক বাঁধ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ দুর্বল হয়ে পড়ছে। ইতিমধ্যে ব্লক বাঁধের কয়েকটি স্থান ধসে গেছে। জিওব্যাগ বিলীন হচ্ছে। অস্বাভাবিক জোয়ার যদি চাপ দেয়, তবে হাকিমুদ্দিন বাজারটি বিলীনের ঝুঁকিতে আছে।

সরেজমিন দেখা যায়, টবগী ইউনিয়নের দালালপুর ছয়আনি রাস্তার মাথা থেকে দক্ষিণে উত্তর-খাসের হাটের আগপর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার তীর-সংরক্ষণ বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুবের বিলের জমির মালিক নুরুল আমিন হাওলাদার বলেন, ইটভাটার মালিকেরা জোরপূর্বক ভেকু মেশিন দিয়ে কৃষিজমির মাটি তুলে নিচ্ছেন। ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে কৃষিজমি নষ্ট করে মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়। তাঁর নিজেরও ৮০ শতাংশ জমির মাটি নিয়ে গেছেন জসিম উদ্দিন হাওলাদার নামের এক ইটভাটার মালিক। বাধা দিলে ৭২ শতাংশ মাটির দাম দিয়েছেন। টবগী ইউনিয়নের মোশারেফ হোসেনসহ অনেক জমির মালিক জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে জোর করে ভাটায় মাটি নেওয়ার অভিযোগ করেন। তাঁর ইটভাটার নাম মেসার্স এসএনএন ব্রিকস। জসিম উদ্দিন হাওলাদার টবগী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতিও।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জসিম উদ্দিন হাওলাদার বলেন, চলতি বছরে তিনি এখনো মাটি সংগ্রহ শুরু করেননি। বিগত সময়ে টাকা দিয়েই মাটি কিনেছেন। জোর করে মাটি নিয়ে ভাটার ব্যবসা করা যায় না। তিনি আগামী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। এ কারণে তাঁর গায়ে কাদা লাগানোর জন্য একটি পক্ষ অপপ্রচার চালাচ্ছে।

এদিকে টবগী ও হাসাননগরের কৃষকদের ভাষ্য, ইটভাটার লোকজন জোর করেই মাটি নিচ্ছেন। চাপ প্রয়োগ করলে নামকাওয়াস্তে টাকা দিচ্ছেন। ১ শতাংশ জমি কিনে এমনভাবে গর্ত করে, তাতে পাশের জমিও ভেঙে পড়ছে। পরে জমির মালিক সেই জমিও বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। টবগী ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি উজ্জ্বল হাওলাদার বলেন, বাঁধের কোল ঘেঁষে মাটি কাটার কারণে হাকিমুদ্দিন বাজার হুমকির মুখে পড়েছে। তাঁর বাড়ির এক-তৃতীয়াংশ ভেঙে গেছে। হাকিমুদ্দিন বাজারের প্রবীণ ব্যবসায়ী মোরশেদ আলম বলেন, ‘উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হাকিমুদ্দিন বাজার। একে সযত্নে আগলে রাখা উচিত। ইটভাটার লোকজন খেত ও খালের মাটি কেটে নেওয়ার কারণে বাজার হুমকির মুখে পড়েছে।

টবগী ইউপি চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কৃষিজমি, খাল ও বাঁধের কোলের মাটি ইটভাটায় যাচ্ছে, এমন অভিযোগ তাঁর কাছে হরহামেশা আসছে। ভাটার মালিকদের নিষেধ করলে তাঁরা বলেন মাটি ক্রয় করছেন। বিষয়টি তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকেও জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে বোরহানউদ্দিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাইফুল ইসলাম জানান, অভিযোগটি তিনি শুনেছেন। বিষয়টি খতিয়ে দেখে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।