মেঘালয়ের পাহাড়ি ঢল সরাসরি আঘাত হানে অরফান্স-মেলিটার ঘরে

পাহাড়ি ঢলে ভেঙে যায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের বাড়িঘর। সম্প্রতি নেত্রকোনার কলমাকান্দার ফুলবাড়ি গ্রামে
প্রথম আলো

১৭ জুন ভোরে অরফান্স মারাকের বাড়িতে থইথই পানি। গোয়ালের গরু ও ভেড়া পাশের উঁচু স্থানে রেখে আসেন। শোবার ঘরে স্ত্রী মেলিটা ঘাঘড়া তখন আলমারি থেকে টাকাপয়সা, স্বর্ণালংকার একটি ব্যাগে ভরতে ব্যস্ত। এমন সময় পাশের মেঘালয়ের পাহাড় থেকে ঢল নেমে আসে। নিমেষেই গুঁড়িয়ে যায় অরফান্সের চৌচালা ঘর।

অরফান্স মারাকের বাড়ি নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার লেংগুরা ইউনিয়নের ফুলবাড়ি গ্রামে। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় তাঁদের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। পঞ্চাশোর্ধ্ব অরফান্স বলেন, ‘কীভাবে যে প্রাণে বেঁচে গেলাম...। ওই সময়ের মধ্যে প্রতিবেশী সুমন মিয়া যদি না আসত, তবে বউ-বাচ্চাসহ তিনজনই পাহাড়ের পানিতে মরতাম।’

অরফান্সদের বাড়ির পেছনে প্রায় ৫০০ গজ দূরে ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়। সেই পাহাড় থেকে হঠাৎ নেমে আসা ঢলে তাঁদের ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। মাত্র ১৫ মিনিটে ঢলের পানিতে ফুলবাড়ি গ্রামসহ জগন্নাথপুর, ছড়াপাড়া ও মধ্যপাড়া এলাকায় বসবাসকারী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, পরিবারগুলো এখন প্রায় নিঃস্ব।

স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, ঢলের পানির সঙ্গে ভারত থেকে বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল, ভ্যান, পিকআপ, তেলের ড্রাম, মৃত গরু-ছাগলসহ অনেক কিছু ভেসে আসে।

অরফান্সের স্ত্রী মেলিটা ঘাঘড়া (৪২) বলেন, ‘ছে-ই দিনের (সেদিনের) ভোরের স্মৃতিতে একনো শিহরিত হই। শরীর কেঁপে ওঠে। বাড়ির পাঁচতা (পাঁচটি) ঘরের মধ্যে চারতাই (চারটা) নিশ্চিহ্ন হইয়া গেছে। যে পাক্কা ঘরতা আছে, সেটাও ভাঙা। বাইচ্চা আছি, এটাই বড়।’

অরফান্স–মেলিটা দম্পতির সঙ্গে প্রতিবেশী সুমন মিয়া
ছবি: প্রথম আলো

অরফান্স গারোদের পরিচালিত লেংগুরা জিবিসি বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। বছর চারেক ধরে স্কুলের চাকরি ছেড়ে ফুলবাড়ি বাজারে একটি ওষুধের দোকান দিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী মেলিটা ঘাঘড়া চট্টগ্রাম শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের নার্স ছিলেন। বিয়ের দীর্ঘদিন পর সন্তান হওয়ায় ওই চাকরি ছেড়ে মেয়ে মেঘাকে নিয়ে বাড়িতে থাকেন।

অরফান্সদের বাঁচাতে এগিয়ে আসা প্রতিবেশী সুমন মিয়া (৩৮) বলেন, ‘আমার বউ ও বাচ্চাকে ফুলবাড়ি বাজারে রাইক্কা দৌড় দিয়া বাড়িত আইয়া দক্ষিণ দিকে চাইয়া দেহি, অরফান্স দাদারা বাঁচাও, বাঁচাও কইয়া চিৎকার দিতাছে। পরে আমি আর সজল মান্দি গরু বাঁধার লম্বা দড়ি আর বাঁশ লাইয়া গাছের সঙ্গে বাইন্দা স্রোতের পানি পাড়ি দিছিলাম। প্রথমে বাচ্চাডারে ঘাড়ে লইয়া নিরাপদ জায়গায় থুইছি।’

সুমন মিয়ার ঘরও ঢলের পানিতে ভেঙে গেছে। পরিবার নিয়ে তিনি এখন ফুলবাড়ি বাজারের একটি দোকানে আশ্রয় নিয়েছেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কোথায় যাবেন, কী খাবেন আলাপকালে জানালেন সে দুশ্চিন্তার কথা।

লেঙ্গুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, তাঁর ইউনিয়নে বিভিন্ন গ্রামে অন্তত ২৭০টি বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।

কলমাকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুল হাসেম বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করা হচ্ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করে সহযোগিতা করা হবে।