মেহেরপুরে ১৪ দিনের লকডাউনের প্রথম দিনে কঠোর প্রশাসন

মেহেরপুরে ১৪ দিনের কঠোর লকডাউনের প্রথম দিন রাস্তাঘাট পুরোটা সময় ছিল পুলিশের নিয়ন্ত্রনে। বৃহস্পতিবার দুপুরে মেহেরপুর পৌর শহরেপ্রথম আলো

করোনা সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় মেহেরপুরে আজ বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে ১৪ দিনের কঠোর লকডাউন। লকডাউন বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসন সকাল থেকেই বন্ধ করে দিয়েছে দূরপাল্লার পরিবহনসহ আন্তজেলার সব লোকাল বাস সার্ভিস। জরুরি পরিষেবা ছাড়া বন্ধ করা হয়েছে দোকানপাট, শপিং মল, ইজিবাইক, রিকশা, ভ্যান, লেগুনা, প্রাইভেট কার। অকারণে মানুষ যাতে বাইরে ঘোরাফেরা না করতে পারে, সে জন্য জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত ও পুলিশ বাহিনী রয়েছে কঠোর ভূমিকায়।

চলতি মাসের শুরু থেকে মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে করোনার প্রকোপ বাড়তে শুরু করে। প্রতিদিন গড়ে ৫০ জন শনাক্ত হতে শুরু করেন। এক সপ্তাহে ৬ জন মারা যান। এ কারণে জেলা প্রশাসন মুজিবনগর ও গাংনী উপজেলার তিনটি গ্রামকে প্রথম লকডাউন করে। পরে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির ভার্চ্যুয়াল সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কমিটির সুপারিশে জেলায় ১৪ দিনের লকডাউন ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়।

লকডাউন চলাকালে কাঁচাবাজার, মাছের বাজারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দোকান, মুদিদোকান ও খাবারের দোকান সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত খোলা রাখা হবে। তবে সার্বক্ষণিক খোলা থাকবে ওষুধের মতো জরুরি পরিষেবার দোকান। হোটেল-রেস্তোরাঁ খোলা রাখলেও থাকছে না বসে খাওয়ার সুযোগ, কেবল পার্সেল নেওয়া যাবে। কাঁচাবাজারগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিচালনার জন্য যথাসম্ভব খোলা স্থানে সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া বন্ধ থাকবে সব পার্ক, রিসোর্টসহ পর্যটনকেন্দ্র, জনসমাবেশ, সামাজিক অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান। জেলা প্রশাসনের প্রজ্ঞাপন মাইকিং করে গতকাল সন্ধ্যা থেকে ইউনিয়ন কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হচ্ছে।

সরেজমিন চিত্র

সকাল থেকে দেখা যায়, সদর পৌর শহরের বাস টার্মিনালে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে দূরপাল্লাসহ আন্তজেলার সব পরিবহন। বাস কাউন্টারগুলো বন্ধ। পৌর শহরের ব্যস্ততম এলাকা বড় বাজার, হোটেল বাজার, কোর্ট মোড়, পুরাতন বাসস্ট্যান্ড একেবারে জনমানবশূন্য। কিছুক্ষণ পরপর পুলিশের গাড়িগুলো দ্রুতগতিতে চলাফেরা করছে। মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি থানা-পুলিশের টহলদলকে দেখা গেছে।

মুজিবনগর কেদারগঞ্জ বাজারে বেলা ১১টার দিকে কয়েকটি দোকান খোলা ছিল। পরে মুজিবনগর থানা-পুলিশের একটি টহলদল এসে দোকানগুলো বন্ধ করে দেয়। আবারও দোকান খুললে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেয় পুলিশ। তবে নানা অজুহাতে মোটরসাইকেলচালকদের আনাগোনা লক্ষ করা গেছে। বিভিন্ন চেকপোস্টে পুলিশের সঙ্গে মোটরসাইকেলচালকদের বাগ্‌বিতণ্ডা দেখা গেছে। মুজিবনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল হাশেম বলেন, ১৪ দিনের লকডাউনের প্রথম দিনে অনেকে দোকানপাট খোলার চেষ্টা করেছেন। অনেকে অহেতুক মোটরসাইকেল চালিয়ে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করার চেষ্টা করছেন। পুলিশ কঠোর ভূমিকায় রয়েছে। করোনা সংক্রমণ কমাতে পুলিশ প্রয়োজন হলে আরও কঠোর হবে।

মেহেরপুরে ১৪ দিনের কঠোর লকডাউনের প্রথম দিন দোকানপাট সব ছিল বন্ধ। রাস্তাঘাট ছিল পুরো ফাঁকা। বৃহস্পতিবার দুপুরে মেহেরপুর পৌর শহরে
প্রথম আলো

সদর পৌর শহরে ঢোকার মোট আটটি প্রবেশদ্বারে পুলিশের চেকপোস্ট ও তদারকি ছিল চোখে পড়ার মতো। ইজিবাইক একেবারে চলতে দেখা যায়নি। অনেকে ভ্যানে করে হাসপাতালে যাওয়ার পথে পুলিশের চেকপোস্টে জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়েন। এ সময় কাথুলী সড়কে পুলিশের চেকপোস্ট জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে দেখা যায় জুয়েল রানা নামের এক ব্যক্তিকে। গাংনী উপজেলার বাসিন্দা জুয়েল মোটরসাইকেলে করে তাঁর ছোট বোনকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পুলিশ সব শুনে তাঁকে হাসপাতালে যেতে দিয়েছে। জুয়েল বলেন, গতকাল বুধবার সন্ধ্যা থেকে তাঁর বোনের প্রথমে মাথাব্যথা শুরু হয়। পরে বমি করে তিনবার। এ কারণে সকালে হাসপাতালে নিয়ে ডাক্তার দেখানোর জন্য লকডাউনের মধ্যে বের হয়েছেন।

জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম রসুল বলেন, লকডাউনে প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়ে খাদ্যসহায়তার কথা বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে জেলা পরিষদের কর্মকর্তারা দরিদ্র মানুষদের তালিকা তৈরিতে কাজ করছেন। লকডাউন বাস্তবায়নে প্রশাসনকে সার্বিক সহযোগিতা করছে জেলা পরিষদ।

বাড়ানো হয়েছে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা

মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক রফিকুল ইসলাম বলেন, জেলায় করোনা সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে পৌর শহরসহ আশপাশে সর্বত্র করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। হাসপাতালের করোনা ইউনিটের রেড জোনে বর্তমানে ৩৫ জন করোনা রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। আইসোলেশন ওয়ার্ডে ৭ জন রয়েছেন। হাসপাতালে র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা চলছে। আইসোলেশনে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদেরও নিয়মিত অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করা হচ্ছে।

মেহেরপুরে ১৪ দিনের কঠোর লকডাউনের প্রথম দিন রাস্তাঘাট পুরোটা সময় ছিল পুলিশের নিয়ন্ত্রনে। বৃহস্পতিবার দুপুরে মেহেরপুর পৌর শহরে
প্রথম আলো

গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তত্ত্বাবধায়ক এম কে রেজা বলেন, মেহেরপুর জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি করোনা রোগী রয়েছেন এই উপজেলাতে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা চলমান রয়েছে। নমুনা পরীক্ষায় সব এলাকাতে কমবেশি করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে।

জেলা সিভিল সার্জন নাসির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেহেরপুরে এ পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়ে ৩৮ জন মারা গেছেন। কয়েক দিন ধরে পৌর শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে অ্যান্টিজেন পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাতে শহরের অনেক বাসিন্দা করোনা পজিটিভ শনাক্ত হচ্ছেন। অনেকে আক্রান্ত হলেও একেবারে কোনো উপসর্গ নেই। একমাত্র সামাজিক সচেতনতা ছাড়া করোনা মোকাবিলা করা আমাদের একার পক্ষে সম্ভব নয়।’

সদর পৌরসভার মেয়র মাহফুজুর রহমান লকডাউনের প্রথম দিনে করোনা আক্রান্ত পরিবারে খাদ্য সহয়তা প্রদান করেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে
প্রথম আলো

জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪৭ জন। জেনারেল হাসপাতালে করোনা ইউনিটে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৩৯ জন রোগী। আইসোলেশনে রয়েছে ৭ জন। বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৩০৩ জন। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১ হাজার ৫৩৮। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১ হাজার ৫২ জন।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মুনসুর আলম খান বলেন, চলতি মাসজুড়ে মেহেরপুরের করোনা পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে অনীহা রয়েছে। অনেকে করোনা সংক্রমণ নিয়ে চলাফেরা করছে। অনেকের একেবারেই কোনো উপসর্গ নেই। কিন্তু ওই ব্যক্তির দ্বারা অনেকে সংক্রমিত হচ্ছেন। এ কারণে করোনা প্রতিরোধ কমিটির সুপারিশে ১৪ দিনে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। লকডাউন বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন কঠোর ভূমিকায় থাকবে।