মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার তিন বছর, ইশতেহারের বেশির ভাগই পূরণ হয়নি

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. মনিরুল হক সাক্কু দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নিয়েছেন—আজ তার তিন বছর পূর্ণ হলো। ২০১৭ সালের ১৭ মে তিনি মেয়রের দায়িত্ব নেন। মেয়র তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে কুমিল্লাকে ‘বিশ্বমানের শহরে’ পরিণত করাসহ ২৭ দফা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যার বেশির ভাগই তিনি পূরণ করতে পারেননি।

২০১৭ সালের ৩০ মার্চ কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়। স্থানীয় সূত্র জানায়, এই নির্বাচন উপলক্ষে ২০১৭ সালের ২৪ মার্চ এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলন করে ২৭ দফা নির্বাচনী ইশতেহার দেন নির্বাচনে বিএনপিদলীয় মেয়র প্রার্থী মো. মনিরুল হক সাক্কু। এতে তিনি জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, যানজট নিরসন, নতুন করে করের বোঝা না চাপানো, নওয়াব ফয়জুন্নেছার নামে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, কুমিল্লায় প্রকৌশল এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, লালমাই পাহাড়ের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর জন্য মাতৃভাষা কেন্দ্র স্থাপন, উপমহাদেশের কিংবদন্তি সংগীতজ্ঞ শচীন দেববর্মণের নামে সংগীত কলেজ, কুমিল্লা নগরের দক্ষিণ এলাকায় মেয়েদের জন্য দুটি ও ছেলেদের জন্য একটি বিদ্যালয় স্থাপন, নগর সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র স্থাপন, নগরের ২৭টি ওয়ার্ডে কীর্তিমান ব্যক্তিদের নামে পাঠাগার স্থাপন, পর্যটনকেন্দ্র স্থাপন, মা ও শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন, কর্মজীবী নারীদের জন্য ইপিজেড এলাকার পাশে হোস্টেল ও শৌচাগার নির্মাণ, নকশা প্রণয়নে দ্রুত সিদ্ধান্ত, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, কাঁচা রাস্তা পাকাকরণ, নালা নির্মাণ, নগরের দক্ষিণ এলাকায় স্টেডিয়াম নির্মাণ, রাতের আলোকসজ্জা বাড়ানো, সড়ক ও স্থাপনার নাম মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ, নিউমার্কেটে আইটি সেন্টার স্থাপন, হকার পুনর্বাসন, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের আবাসন, বস্তির উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কাঁচাবাজার সংস্কার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, মুক্তিযোদ্ধাদের হোল্ডিং কর ও পানির বিল মওকুফ, সন্ত্রাস-মাদকমুক্ত কুমিল্লা গঠন এবং কুমিল্লা নামে কুমিল্লা বিভাগের নাম রাখার জন্য কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন।

নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানাকে ১১ হাজার ৮৫ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে জয়ী হন। এরপর ওই বছরের ১১ মে শপথ নেন। আর ১৭ মে নেন দায়িত্ব। নগরবাসীর অভিযোগ, দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার তিন বছরে গতানুগতিক কাজ ছাড়া মেয়র সৃজনশীল কোনো কাজে হাত দেননি। অথচ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো। চাইলেই নগরের চেহারা পাল্টে দিতে পারতেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কুমিল্লার সাবেক সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মমিনুল হক চৌধুরী বলেন, ‘নির্বাচন এলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য ইশতেহার দেওয়া হয়। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর এগুলোর ধারেকাছেও তাঁরা থাকেন না। নগরের জলাবদ্ধতা, যানজট এখনো নিরসন হয়নি। নালা তৈরি করা হলেও এগুলো একেবারে ঢাকনা দেওয়া আছে। কিন্তু সেগুলো খোলার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে পানি জমে থাকে। নগরের ঠাকুরপাড়া এলাকায় এই সমস্যা প্রকট। আমার মতে, নগরে গতানুগতিক কাজ হলেও শিক্ষা, সংস্কৃতি ও স্বাস্থ্য সেক্টরের উন্নয়নে পিছিয়ে আছেন মেয়র।’

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়র মো. মনিরুল হক আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচন এলে অনেক প্রতিশ্রুতি দিতে হয়। এগুলো রক্ষার চেষ্টা করা হয়। কোনোটি পারি। কোনোটি পারি না। তার ওপর একেক সময়ে একেক সমস্যা চলে আসে। এগুলো সমাধান করতে হয়। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে নানা ধরনের অগ্রাধিকার কাজ করতে হয়। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, আলোকসজ্জা, সৌন্দর্যবর্ধন, নালা তৈরি, নতুন রাস্তা পাকাকরণ—এগুলোতে আমি সফল। যানজট নিরসন করতে হলে সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার। অন্যান্য নির্বাচনী ইশতেহার পূরণ করতে সময় লাগবে। বরাদ্দের বিষয় আছে। ঈদের পর নকশা অনুমোদন দেওয়া হবে। আমাদের এখানে ২ হাজার ৮০০ নকশার আবেদন জমা পড়েছে। জনবল কাঠামোও অনুমোদন পাওয়ার শেষ ধাপে আছে। করোনাভাইরাসের কারণে আমরা কিছুটা পিছিয়ে আছি।’

আপনি তো বিএনপিদলীয় মেয়র, নগরের উন্নয়নে সরকারদলীয় লোকদের সহযোগিতা পাচ্ছেন কেমন—এমন প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, ‘সরকারদলীয় মন্ত্রী-সাংসদের সঙ্গে সামঞ্জস্য ও সমন্বয় না থাকলে কুমিল্লা নগরের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। স্থানীয় সাংসদের সঙ্গে আমার রাজনৈতিক কোনো সম্পর্ক নেই। আছে উন্নয়নের সম্পর্ক। বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগের মেয়র ও পৌর চেয়ারম্যানরাও উন্নয়নের জন্য একসঙ্গে কাজ করেছেন। আশা করি নির্বাচনী ইশতেহার ছাড়া নগরবাসীর সমস্যা আগামী দুই বছরের মধ্যে পূরণ করা হবে।’

২০১১ সালের ১০ জুলাই কুমিল্লা সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠা হয়। এরপর ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মো. মনিরুল হক সাক্কু কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেন। টানা দুবার তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। তারও আগে ২০০৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে তিনি কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যান (বর্তমানে মেয়র) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।