‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র দেশে সাহিত্যচর্চা

সাহিত্যচর্চায় কবি, লেখক, শিল্পীরা অনুষ্ঠান আর আড্ডায় মেতে থাকেন
ছবি: প্রথম আলো

শুক্রবারকে বলা যেতে পারে ময়মনসিংহের শিল্প-সাহিত্যের ‘হাটবার’। সপ্তাহের ছুটির এ দিনে শিল্প-সাহিত্যের কর্মীদের যেন দম ফেলার ফুরসত থাকে না। নানা সংগঠনের উদ্যোগে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে নানা আয়োজন। কবি, লেখক, শিল্পীরা ওই সব অনুষ্ঠান আর আড্ডায় মেতে থেকে কাটান সপ্তাহের এই একটি দিন। শুক্রবারের আয়োজনগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলেই ধারণা করা যায় ময়মনসিংহের শিল্প-সাহিত্যচর্চার গভীরতা।

ময়মনসিংহকে বলাই হয় শিল্প-সাহিত্যের জেলা। এর পেছনে রয়েছে মৈমনসিংহ গীতিকার মতো সমৃদ্ধ ইতিহাস আর ঐতিহ্যের প্রবহমান স্রোতোধারা। এই ধারাকে শিয়রে নিয়ে উত্তরসূরিরা চালাচ্ছেন শিল্প-সাহিত্যের নিবিড় চর্চা। ময়মনসিংহ শহরকেন্দ্রিক শিল্প ও সাহিত্যবিষয়ক যেসব সংগঠন রয়েছে, একেকটা সংগঠনের বয়স দেখলেই বোঝা যায় এ শহরে দীর্ঘ চর্চার ইতিহাস রয়েছে। শহর ছাড়া বিভিন্ন উপজেলাতেও গড়ে উঠেছে সাহিত্য সংগঠন। এসব সংগঠন সারা দেশের কবি-লেখকদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ যোগাযোগ ও সাহিত্যের বিনিময় অব্যাহত রেখেছে। এ জেলা থেকে বের হয় সাহিত্যের সমৃদ্ধ সব ছোটকাগজ। পাশাপাশি রয়েছে অনেক নাট্যসংগঠন আর চিত্রশিল্পীদের সংগঠন। এসব সংগঠন নিয়মিত চর্চার পাশাপাশি দেশব্যাপী সৃষ্টিশীল কাজের বিনিয়ম করেন।

শিল্প-সাহিত্যচর্চার আরেকটি স্রোতোধারা পাঠচক্রের আসর। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই আসে ‘বীক্ষণ’-এর নাম। প্রতি শুক্রবার ব্রহ্মপুত্র নদের পারে জয়নুল আবেদিন উদ্যানে ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের সাপ্তাহিক এ পাঠচক্রের আসরটি বসে। ৩৮ বছর ধরে নিয়মিত চলে আসা এ পাঠচক্রের আসরটি কোনো শুক্রবার বন্ধ থাকেনি। এতগুলো বছরে নানা প্রতিকূলতা এসেছে। এমনকি করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শুরুর দিকে কয়েক মাস ভার্চ্যুয়াল আসরের মাধ্যমে পাঠচক্র চলমান রাখা হয়েছে।

ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮০ সালে। আর এ সংসদের পাঠচক্র আসর বীক্ষণ জন্ম নেয় ১৯৮৩ সালে। বীক্ষণের আসরে আলোচনা হয় দেশ ও বিশ্বের সমকালীন-ঐতিহাসিক সব বিষয়। সাহিত্যের পাশাপাশি এখানে বিশ্বের রাজনীতি, সংকট, যুদ্ধবিগ্রহ নিয়েও হয় আলোচনা। বীক্ষণের নামকরণ করা কবি শামসুল ফয়েজ বলেন, ‘শিল্প-সাহিত্যচর্চায় ময়মনসিংহ বহুকাল ধরেই সমৃদ্ধ। মৈমনসিংহ গীতিকার দেশ হিসেবে খ্যাত আমাদের ময়মনসিংহ। এখানে বসবাস করেছেন যতীন সরকার (বর্তমানে নেত্রকোনায় বসবাসরত) ও গোলাম সামদানী কোরায়শীর মতো মনীষী। তাঁদের অনুপ্রেরণা মেনে চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন ময়মনসিংহের পরবর্তী প্রজন্মের কবি-লেখকেরা।’

নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে তাজমহল আবাসিক হোটেল হয়ে গেলে আড্ডা ঘুরে বেড়ায় স্টেশন চত্বরের ফয়েজ অঙ্গন, মালগুদাম, গাঙ্গিনারপাড়ে চুন্নু মিয়ার হোটেল, টাউন হলের আফা মিয়ার হোটেল আর থানার ঘাটে। বর্তমানে ছোট বাজার প্রেসপাড়ার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ‘গ্রাফিটি’তে তুমুল কর্মব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে চলে কবি-লেখকের চায়ের আড্ডা।

বীক্ষণ দিয়ে শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে ময়মনসিংহে আরও একাধিক নিয়মিত পাঠচক্রের আসর শুরু হয়। ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার অনুশীলন সাহিত্য সংসদের নিয়মিত সাহিত্যের আসর বসে প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেলে। ১৯৯৩ সালে অনুশীলন সাহিত্য সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রয়াত কবি হোসেন আলী মিয়া ও কবি সরকার আজিজকে সামনে রেখে একদল তরুণ কবি অনুশীলন সাহিত্য সংসদ গড়ে তোলেন। কয়েক বছর ধরে কিছুটা অনিয়মিত হলেও অনুশীলন সাহিত্য সংসদ নিজেদের হাজারতম সাহিত্য আসরের মাইলফলক ছুঁয়েছে ২০১৮ সালে। ঢাকার শাহবাগের আজিজ মার্কেটকেন্দ্রিক তরুণ কবিরা নানা উপলক্ষে আসেন তারাকান্দায়। ২০১৯ সালে তারাকান্দায় প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যচর্চার আরেকটি কেন্দ্র তারাকান্দা গণপাঠাগার। এ পাঠাগারের উদ্যোগে প্রতি মাসে একবার পূর্বনির্ধারিত একজন কবির সামগ্রিক কাব্যচর্চা নিয়ে খুঁটিনাটি আলোচনা হয়।

অনুশীলন সাহিত্য সংসদ আর তারাকান্দা গণপাঠাগারের সঙ্গে যুক্ত থাকা কবি সরকার আজিজ বলেন, ‘তারাকান্দা উপজেলা হওয়ার ২০ বছর আগে এখানে আমরা অনুশীলন সাহিত্য সংসদ প্রতিষ্ঠা করি। একসময় নিয়মিত প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত নির্ধারিত বিষয়ে আলোচনা হতো। ঢাকা ও ময়মনসিংহের তরুণ কবিরা আলোচনায় অংশ নিতেন। অনুশীলনের সঙ্গে থাকা তরুণ কবিরা আজ অনেকেই প্রতিষ্ঠিত। তাঁরা এখন ঢাকায় বসে সাহিত্য আর সাংবাদিকতা করে যাচ্ছেন।’

শিল্প-সাহিত্যচর্চার জন্য প্রয়োজন সৃজনশীল আড্ডা। ময়মনসিংহ শহরকেন্দ্রিক বিভিন্ন সংগঠনের আয়োজন থাকে নিয়মিত
ছবি: প্রথম আলো

ময়মনসিংহ বিভাগ হওয়ার পর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগীয় সাহিত্য পরিষদ। ময়মনসিংহকে কেন্দ্র করে নেত্রকোনা ও শেরপুর জেলাতেও এ সাহিত্য পরিষদের শাখা গঠন করা হয়েছে। জামালপুরেও শাখা খোলার প্রক্রিয়া চলছে। প্রতি শুক্রবার ‘চতুরঙ্গ’ নামে বিভাগীয় সাহিত্য পরিষদ পাঠচক্র করে আসছে প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে। পরিষদের বর্তমান সভাপতি কাব্য সুমি সরকার বলেন, চতুরঙ্গ আসরে ময়মনসিংহের নবীন ও প্রবীণ কবি-লেখকদের মধ্যে আড্ডা-আলোচনা হয়। প্রতি শুক্রবার বিকেলে চরপাড়া কপিখেত এলাকায় এ পাঠচক্র আসরটি বসে।

অনিয়মিত হলেও ময়মনসিংহের আরেক জনপ্রিয় পাঠচক্রের নাম ‘নৈঃশব্দ্য আড্ডা’। এ পাঠচক্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, প্রতিটি পাঠচক্রের চুম্বক অংশ নিয়ে প্রকাশনা হয়। পাঠচক্রে উপস্থিতদের মধ্য থেকে একজনের মুখ হয় প্রকাশনার প্রচ্ছদ।

ময়মনসিংহ থেকে নিয়মিত ও অনিয়মিতভাবে বের হয় বেশ কিছু ছোটকাগজ বা লিটল ম্যাগ। লিটল ম্যাগ আন্দোলনের ভরা বসন্ত সাহিত্যের শূন্য দশকে (২০০০ সালের পর) ময়মনসিংহের তরুণ কবিরা নিজেদের সম্পাদনায় ছোটকাগজ প্রকাশ করার যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। দারুণ দারুণ নাম ছিল সেসব ছোট কাগজের। ময়মনসিংহের ছোট কাগজগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সরকার আজিজ সম্পাদিত ময়মনসিংহ জং, কবি সাব্বির রেজা সম্পাদিত অদ্বৈত, কামাল মুহম্মদ সম্পাদিত অনুশীলন আড্ডা, এহসান হাবীব সম্পাদিত শূন্য, কাজী নাসির মামুন সম্পাদিত মেইন রোড, আশিক আকবর সম্পাদিত দেবদারু, গৌতম কৈরী সম্পাদিত ঘুড্ডি, শাখাওয়াত বকুল সম্পাদিত অতঃপর এবং শরৎ সেলিম সম্পাদিত শ্রাবস্তি।

করোনাভাইরাসের কারণে গত বছর নাটকপাড়ায় কিছুটা ভাটা ছিল। এর আগে ২০১৯ সালে ময়মনসিংহে মোট ৬৪টি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে।

শিল্প-সাহিত্যচর্চার জন্য প্রয়োজন সৃজনশীল আড্ডা। কবি-লেখকদের আড্ডার জন্য পুরান ঢাকার বিউটি বোর্ডিংয়ের নাম যেমন দেশের মননশীল মানুষদের সবার জানা, তেমনই অনেকটা বিউটি বোর্ডিংয়ের মতোই সৃজনশীল আড্ডার ডেরা ছিল ময়মনসিংহের ‘তাজমহল’ রেস্তোরাঁ। ব্যবসায় ক্ষতির মুখে পড়লে স্টেশন রোডে তাজমহল রেস্তোরাঁ ভেঙে পরবর্তী সময়ে আবাসিক হোটেল করার আগপর্যন্ত সেখানে তুমুল আড্ডা হতো কবি-লেখকদের। বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত প্রয়াত কবি মুশাররফ করিমের হাত ধরে আশির দশকে তাজমহলের আড্ডা শুরু হয়। পরে এতে যোগ দেন কবি শামসুল ফয়েজ, ইয়াজদানী কোরায়শী, সেলিম মাহমুদ, গাউসুর রহমান, আশরাফ মীর, সোহরাব পাশা ও তসলিমা নাসরিনের মতো তৎকালীন তরুণ কবিরা।

নিয়মিত সংস্কৃতিচর্চার অংশ হিসেবে ময়মনসিংহের মঞ্চে প্রায় সব সময় কোনো না কোনো অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। ময়মনসিংহ টাউন হল মঞ্চে আয়োজিত অনুষ্ঠানে একদল শিল্পী
ছবি: প্রথম আলো

নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে তাজমহল আবাসিক হোটেল হয়ে গেলে আড্ডা ঘুরে বেড়ায় স্টেশন চত্বরের ফয়েজ অঙ্গন, মালগুদাম, গাঙ্গিনারপাড়ে চুন্নু মিয়ার হোটেল, টাউন হলের আফা মিয়ার হোটেল আর থানার ঘাটে। বর্তমানে ছোট বাজার প্রেসপাড়ার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ‘গ্রাফিটি’তে তুমুল কর্মব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে চলে কবি-লেখকের চায়ের আড্ডা। গ্রাফিটির কর্ণধার তরুণ কবি শামীম আশরাফ কবিদের আড্ডাকে জমিয়ে রাখতে গ্রাফিটির বোর্ডে প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন নির্বাচিত কবিদের কবিতা প্রকাশ করেন।

সাহিত্যের পর গর্ব নিয়ে বলা যায় ময়মনসিংহের সমৃদ্ধ নাট্যচর্চার কথা। ময়মনসিংহে বর্তমানে ২৭টি নাট্যসংগঠন রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বহুরূপী নাট্য সংস্থা, বিদ্রোহী নাট্যগোষ্ঠী, ছায়ানট নাট্য সংস্থা, লোককৃষ্টি নাট্য সংস্থা, অনসাম্বল নাট্য থিয়েটার, মুখোশ নাট্য সংস্থা, ঝিলিক নাট্য সংস্থা, জাগরণী নাট্যগোষ্ঠী, থিয়েটার সংলাপ ও রঙ্গভূমি থিয়েটার। এসব নাট্যসংগঠন নিয়মিত চর্চা ও মঞ্চায়ন চালিয়ে যাচ্ছে।

অনসাম্বল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা মো. আবুল মনসুর বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে গত বছর নাটকপাড়ায় কিছুটা ভাটা ছিল। এর আগে ২০১৯ সালে ময়মনসিংহে মোট ৬৪টি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। অনসাম্বল থিয়েটার কোর্ট মার্শাল নাটকটি শততম মঞ্চায়ন করেছে ঘটা করে।

ময়মনসিংহে শিল্প-সাহিত্যের চর্চায় জেলা শিল্পকলা একাডেমিও বড় ভূমিকা রাখছে। চার বছর ধরে জেলা শিল্পকলা একাডেমি নিয়মিতভাবে ‘পাক্ষিক শ্রোতার আসর’ ও ‘পাক্ষিক সাহিত্যের আসর’ করে আসছে। এসব আসরে প্রবীণ ও নবীন শিল্পীরা সুযোগ পাচ্ছেন। এ ছাড়া ময়মনসিংহ শিল্পকলা একাডেমি দুই বছর ধরে রাতব্যাপী উচ্চাঙ্গসংগীতের আসর করে আসছে।

ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বসে ছবি আঁকতেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। শিল্পাচার্যের ছবির মতোই সুন্দর এই নদের পাড় মুখর থাকে সংস্কৃতিকর্মীদের নানা কর্মকাণ্ডে
ছবি: আনোয়ার হোসেন

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের শহরে পিছিয়ে নেই চিত্রশিল্পীরাও। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে যেখানে বসে ছবি আঁকতেন জয়নুল, সেখানে রয়েছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা। সরকারিভাবে পরিচালিত এ সংগ্রহশালাটিতে জয়নুলের চিত্রকর্ম ও ব্যবহার্য জিনিস রয়েছে। জয়নুল সংগ্রহশালার পাশে ময়মনসিংহের চিত্রশিল্পীরা ‘ব্রহ্মশৈলী’ নামে একটি গ্যালারি করেছেন। এখানে নিজেদের আঁকা ছবির প্রদর্শনী হয়। ময়মনসিংহে রয়েছে চিত্রশিল্পীদের সংগঠন ময়মনসিংহ বিভাগীয় চারুশিল্পী পর্ষদ। এ ছাড়া ‘জলাবেগ’ নামের আরও একটি সংগঠন রয়েছে। প্রতিকূলতার মধ্যেও এসব সংগঠন ছবি আঁকার নিয়মিত চর্চা ও প্রদর্শনীর আয়োজন করে আসছে।