মোটরসাইকেলে দা-লাঠি হাতে নিয়ে সেলফি

প্রতীকী ছবি

পাকা সড়কের পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে দুটি মোটরসাইকেল। সঙ্গে বেশ কয়েকজন কিশোর দাঁড়ানো। প্রথমজনের হাতে একটি বগি দা (লম্বা দা)। তাকে জড়িয়ে ধরে থাকা ছেলেটির হাতে একটি লাঠি। তার পাশের ছেলেটির হাতেও লাঠি। এরপরের কিশোরটির হাতে আরও একটি লম্বা দা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পাওয়া গেছে এমন একটি ছবি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছবিটি বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার। ছবির সবাই এলাকায় ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে পরিচিত। এই কিশোরদের একজনই ১ অক্টোবর এমন দুটি ছবি নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার করেছিল।

কিশোর গ্যাংয়ের হাতে গত বছরের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্যে রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আলোচিত এ হত্যা মামলার রায় দেওয়া হয়েছে গত ৩০ সেপ্টেম্বর। ঠিক এ সময়ই পাথরঘাটায় একদল কিশোর অস্ত্র হাতে নিয়ে সেলফির ঘটনায় এলাকায় বেশ আলোচনা চলছে। এই কিশোর গ্যাংয়ের মূল নেতাকে (১৭) গতকাল বৃহস্পতিবার আটক করেছে পুলিশ।

পাথরঘাটার এক আইনজীবী বলেন, সম্প্রতি পাথরঘাটা পৌর এলাকায় স্কুলপড়ুয়া কিশোরদের ছোট ছোট কয়েকটি গ্যাং তৈরি হয়েছে। তারা মোটরসাইকেল নিয়ে বেপরোয়াভাবে প্রতিনিয়ত মহড়া দেয়। একে অন্যের সঙ্গে মারামারিতে লিপ্ত হচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে মাদক সেবনেরও অভিযোগ রয়েছে। কিশোর দলের এমন সন্ত্রাসী তৎপরতায় অভিভাবকেরা সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।

ফেসবুকে শেয়ার করা ছবির সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছবি আপলোডকারী ওই অ্যাকাউন্ট পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের এক নেতার। ছবিতে তার সঙ্গে ছিলেন পাথরঘাটা পৌর ছাত্রলীগের সম্পাদক পর্যায়ের একজন, পৌর ছাত্রলীগের একটি ওয়ার্ডের সভাপতি, সদর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের এক নেতা এবং পাথরঘাটা আলিয়া মাদ্রাসা ছাত্রলীগের এক নেতা আছে। তারা সবাই অপ্রাপ্তবয়স্ক।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কিশোরদের এই গ্যাং বা বাহিনীর নেতৃত্ব দেয় পাথরঘাটা পৌর ছাত্রলীগের একটি ওয়ার্ডের সভাপতি (১৭)। সে পাথরঘাটা কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। এই ছাত্র উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমানের আত্মীয়। এ বাহিনীতে কালমেঘা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের এক নেতা, পৌর ছাত্রলীগের সম্পাদক পর্যায়ের একজন, পৌর এলাকার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের একজন, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দুজন ও মুন্সিগঞ্জ এলাকার একজন রয়েছে।

ওয়ার্ড ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে ছাত্রলীগের এই অংশ দীর্ঘদিন ধরে পাথরঘাটা পৌর এলাকায় নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে মাদক সেবন, বখাটেপনা, উত্ত্যক্ত করাসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে ।

এলাকার একাধিক সূত্র জানায়, ওয়ার্ড ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে ছাত্রলীগের এই অংশ দীর্ঘদিন ধরে পাথরঘাটা পৌর এলাকায় নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। বিশেষ করে মাদক সেবন, বখাটেপনা, উত্ত্যক্ত করাসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। গ্রুপটি গত ২৮ সেপ্টেম্বর পাথরঘাটা কলেজ গেটে চার কিশোরকে মারধর করে। এতে দুজন মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে রক্তাক্ত ও জখম হয়। মাস দুয়েক আগে এই কিশোর বাহিনীর সদস্যরা পাথরঘাটা শহরে ইমান আলী সড়কের দক্ষিণ দিকে ৮–১০ জন কিশোরকে মারধর করে। পাথরঘাটা ডিগ্রি কলেজের একাধিক ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করারও অভিযোগ আছে এ কিশোর বাহিনীর বিরুদ্ধে।

পাথরঘাটা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর হোসাইন মুঠোফোনে বলেন, ‘এর (কিশোর গ্যাংয়ের নেতা) বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ আসার পর আমি বিষয়টি পাথরঘাটা উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হাফিজুর রহমানকে জানিয়েছিলাম। পরে হাফিজুর রহমান প্রতিশ্রুতি দিয়ে যায়, এ ধরনের কাজ সে আর করবে না।’
উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এবং উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান বলেন, ছাত্রলীগের এই অংশের সঙ্গে প্রতিপক্ষ কিছু কিশোরের বিরোধ চলছে। এ ঘটনায় পাথরঘাটা থানায় লিখিত অভিযোগও রয়েছে। তবে ফেসবুকের ওই ছবি সম্পর্কে তাঁর জানা নেই।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাবির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এরা আসলে স্থানীয় বখাটে। দলের নাম ভাঙিয়ে ব্যক্তির লেজুড়বৃত্তি করে অপকর্ম করে বেড়ায়। এই ছেলেরা ছাত্রলীগের কোনো কমিটিতে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়ে আইনে সোপর্দ করা হবে। পৌর ছাত্রলীগের সভাপতি এনামুল বেল্লাল বলেন, কিশোর গ্যাংয়ে জড়িত তিনজনকে তাঁরা চিহ্নিত করে সংগঠন থেকে বহিষ্কারের জন্য জেলা কমিটির কাছে সুপারিশ করেছেন।

বরগুনা ডিবি পুলিশের ওসি খন্দকার জাকির হোসেন গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, গ্যাংয়ের এক নেতাকে (১৭) গতকাল আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। পাথরঘাটা থানার ওসি মো. শাহাবউদ্দীন মুঠোফোনে বলেন, ‘কিশোর গ্যাং, ইভ টিজারদের ব্যাপারে আমরা কঠোর অবস্থানে রয়েছি।’