মোটা চালের কেজি ৪০ টাকায় উঠেছে
রাজধানীর বাজারে মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি ৪০ টাকায় উঠেছে, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত রমজান মাসের পর থেকে বাজারে সব ধরনের চালের দাম বাড়ছে। তবে সবচেয়ে বেশি হারে বেড়েছে মোটা চালের দাম। রমজান মাসে গুটি ও স্বর্ণা জাতের মোটা চাল কেজিপ্রতি ২৮ থেকে ৩০ টাকায় মিলত, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়।
এ হিসাবে কেজিপ্রতি দর বেড়েছে ৩৩ থেকে ৪৩ শতাংশ। সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরই বলছে, ঢাকার বাজারে
এখন মোটা চালের দর কেজিপ্রতি ৩৮ থেকে ৪০ টাকা।
দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ মোটা চালের ক্রেতা। দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের খরচ বেড়ে গেছে। ঢাকার পশ্চিম আগারগাঁও এলাকার দিনমজুর রহমত আলী বলেন, তাঁর পাঁচ সদস্যের পরিবারে দৈনিক আড়াই কেজি চাল প্রয়োজন হয়। এ হিসাবে চালের দাম কেজিতে ১০ টাকা বৃদ্ধি পাওয়ায় তাঁর মাসে ৭৫০ টাকা বেশি খরচ হবে।
শুধু মোটা চাল নয়, বেড়েছে মাঝারি ও সরু চালের দামও। মাঝারি মানের বিআর-২৮ চালের দাম কেজিতে ৫ থেকে ৬ টাকা ও সরু মিনিকেট চালের দাম ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। বর্তমানে বাজারে মাঝারি মানের চাল ৪২ থেকে ৪৪ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর সরু মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা দরে।
মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি কারণ আছে বলে মনে করেন চালের মিল মালিক ও ব্যবসায়ীরা। তাঁদের মতে, ভারতীয় চালের আমদানি এত দিন দাম কমিয়ে রেখেছিল। এখন শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়ায় ভারতীয় চাল আসছে না। এ ছাড়া সরকারিভাবে মোটা চাল কেনাও চালের মূল্যবৃদ্ধির কারণ বলে দাবি করেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে খাদ্য মন্ত্রণালয় খোলাবাজারে চাল বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত রোববার খাদ্য মন্ত্রণালয়ে চালকলের মালিকদের সঙ্গে এক বৈঠকের পর খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, প্রাথমিকভাবে চলতি সপ্তাহে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় এ কার্যক্রম শুরু হবে। এ ক্ষেত্রে দর হবে কেজিপ্রতি ১৫ টাকা।
অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৬ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ৩ কোটি ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। যা আগের বছরের চেয়ে ২ লাখ ৫৮ হাজার টন বেশি। মাসখানেকের মধ্যে নতুন আমন চাল বাজারে আসতে শুরু করবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বছরের এ সময়টায় চালের দাম কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক। তবে অন্য সময়ের তুলনায় এ বছর মোটা চালের দাম বেড়েছে অনেক বেশি হারে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদ প্রথম আলোকে বলেন, যারা মোটা চালের ভোক্তা তাদের ওপর দাম বৃদ্ধির একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে তা ততটা মারাত্মক হবে না। কারণ এখন মজুরি অনেক বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, চালের দাম এখন আর ততটা স্পর্শকাতর বিষয় নয়, যতটা আগে ছিল।’
রাজধানীর পশ্চিম আগারগাঁও কাঁচাবাজারের আশপাশে অনেক নিম্ন আয়ের পরিবারের বসবাস। এ কারণে ওই বাজারে মোটা চালের চাহিদা বেশ ভালো। বাজারটির কামরুল হোসেন, আবদুল হাকিমসহ কয়েকজন বিক্রেতা বলেন, চার-পাঁচ মাস আগেও তাঁরা মোটা চাল ২৬ থেকে ২৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন। এখন তা ৪০ টাকার নিচে বিক্রি করলে লাভ থাকে না। আবদুল হাকিম বলেন, তিনি চাল কিনেছেনই কেজিপ্রতি সাড়ে ৩৬ টাকা দরে।
বাজারে গুটির চেয়ে স্বর্ণা চালের দাম একটু বেশি। স্বর্ণাকে অনেকে পারিজা, পাইজাম নামেও ডাকে। এর বাইরে আরেকটি মোটা চাল আছে, যা গোডাউন বা গুদামের চাল বলে পরিচিত। পুরোনো হয়ে যাওয়ায় ও গন্ধের কারণে এ চালটির দাম কম, কেজিপ্রতি ৩৫ টাকা। অবশ্য কয়েক মাস আগে তা ২২ থেকে ২৪ টাকা দরে বিক্রি হতো বলে জানান বিক্রেতারা।
মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের চালের আড়তের অনেক দোকানেই মোটা চাল নেই। গতকাল সোমবার কয়েকটি দোকান ঘুরে খাদ্য ভান্ডার নামের একটি দোকানে মোটা চাল পাওয়া গেল। আড়তের ব্যবস্থাপক হীরা লাল দাস দাম চাইলেন কেজিপ্রতি সাড়ে ৩৭ টাকা। জানতে চাইলে তিনি বলেন, পাঁচ থেকে ছয় মাস আগেও এ চালটির পাইকারি দর ২৪ থেকে ২৫ টাকা ছিল। আর গুদামের চালের দর ছিল ১৮ থেকে ২০ টাকা। এখন গুদামের চালও ৩৩ থেকে ৩৪ টাকা কেজিতে উঠেছে।
একই বাজারের আলিফ রাইস এজেন্সির মালিক আবদুস সালাম বলেন, চাল চাইলে মিলমালিকেরা বলেন, মোটা চাল নেই। এ ছাড়া ভারতীয় চাল আমদানিও বন্ধ। এ কারণেই দাম বেড়েছে।
চালকল মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, এবার সরকার ধান কিনেছে কেজিপ্রতি ২৩ টাকা দরে। এ দরে ধান কিনে চাল উৎপাদন করলে খরচ পড়ে কেজিপ্রতি ৩৫ টাকার কাছাকাছি। তিনি বলেন, এবার মোটা ধানের আবাদ কম হয়েছে। তার ওপর সরকার এক লাখের বদলে এবার ৭ লাখ টন ধান কিনেছে। এসব কারণে মোটা চালের দাম বেড়েছে। তবে মাসখানেকের মধ্যে নতুন চাল আসবে, তখন দাম কমে যাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
কষ্টে নিম্ন আয়ের মানুষ: গতকাল সকালে পশ্চিম আগারগাঁওয়ের বাজারে চাল কিনতে গিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা রহমত আলী। পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে তিনি বসবাস করেন বাজারের পাশেই গড়ে ওঠা কিছু ঝুপড়ি ঘরের একটিতে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, মোটা চালের দাম কিছুদিন পরপরই বাড়ছে। এতে সংসারের খরচ বাড়ছে।
রহমত আলী বলেন, তাঁর পরিবারের সদস্যরা তিন বেলাই ভাত খায়। চালের দাম কেজিতে ১০ টাকা বাড়ায় তাঁর দৈনিক খরচ বেড়েছে ২৫ টাকা। মোটা চাল খাওয়ার কারণ, এ চালের ভাত দীর্ঘক্ষণ পেটে থাকে। ফলে ক্ষুধা কম লাগে। আবার ভাত সহজে পচে না।
মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে আলিফ রাইস এজেন্সিতে মোটা চাল কিনতে গিয়েছিলেন আদাবরের টেইলার্স কর্মী মো. গিয়াস উদ্দিন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাস দেড়েক আগে তিনি এক বস্তা (৫০ কেজি) মোটা চাল কিনেছিলেন ১ হাজার ৪০০ টাকায়। এখন তা ১ হাজার ৮০০ টাকা চাইছে। তিনি আরও বলেন, ‘সকালে বাসার সামনে দোকানদার কেজিপ্রতি ৪০ টাকা চাইল। ভাবলাম আড়তে কমে পাওয়া যাবে। এখানে এসেও দেখি ৩৮ টাকা চাইছে।’
সাম্প্রতিক কালে সর্বোচ্চ দর: কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে দেশে মোটা চালের জাতীয় খুচরা গড় দাম ছিল কেজিপ্রতি প্রায় ২৬ টাকা। পরের দুই বছর তা যথাক্রমে ৩০ ও ৩৩ টাকা ছিল। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে চালের দাম বাড়েনি, বরং কমেছে। এতে কৃষক ধানের দাম পায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। কৃষককে সুরক্ষা দিতে চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার চাল আমদানিতে শুল্কহার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করেছে।
জাতীয় খাদ্য নীতি সক্ষমতা শক্তিশালীকরণ কর্মসূচির ওয়েবসাইটে ২০০৭ সাল থেকে চালের দাম ওঠানামার একটি লেখ চিত্র দেওয়া আছে। তাতে দেখা গেছে, ২০০৮, ২০১০ ও ২০১৩ সালে মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি ৩৫ টাকা বা তার কিছুটা ওপরে উঠেছিল। তবে এখনকার মতো এত দাম কখনোই ছিল না।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় এখন বাংলাদেশেই চালের দাম বেশি। ভারত ও পাকিস্তান থেকে মোটা চাল আমদানি করলে বাংলাদেশের বাজারে সম্ভাব্য মূল্য পড়বে কেজিপ্রতি ৩০ থেকে ৩১ টাকা। অন্যদিকে ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে আতপ চাল আনা যাবে ৩১ থেকে ৩৩ টাকা কেজিতে।