যশোরে দখলে-দূষণে প্রাণহীন নদ–নদী

যশোর শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদের পাশে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। গতকাল শহরের দড়াটানা সেতু এলাকায়ছবি: এহসান-উদ-দৌলা

যশোরে রয়েছে ১৫টি নদ-নদী। দখলের কারণে কয়েকটি নদী ভরাট হয়েছে, নাব্যতা হারিয়েছে। দখলের পাশাপাশি নদ-নদী ব্যাপকভাবে দূষণের শিকার। দূষণে নদীর পানি ও নদীনির্ভর প্রাণবৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। দখল ও দূষণে কয়েকটি নদী মৃতপ্রায়। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন জেলার অবৈধ দখলদারের ৬৭৩ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। তবে এ তালিকা পরিপূর্ণ নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। নদী রক্ষায় তালিকা অনুযায়ী অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কোনো কার্যকর উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে না।

যশোরে আছে কপোতাক্ষ নদ, ভৈরব নদ, হরিহর নদ এবং কোদলা, ইছামতী, হাকর, বেতনা অথবা বেত্রবতী অথবা বেত্রাবতী, মুক্তেশ্বরী, কাজলা, চিত্রা, শ্রী, টেকা, হরি, ভদ্রা ও আতাই নদী।

গত বছর ৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন থেকে যশোরের জেলা প্রশাসককে একটি চিঠি দেয়। এতে উল্লেখ করা হয়, হাইকোর্ট ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি ও  ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি নদ-নদীর দখল, দূষণ, ভরাট, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে একটি ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেছেন। ওই রায়ে আদালত প্রতিটি জেলা, বিভাগ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশনের অধিক্ষেত্রনাধীন নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় জলাধারের অবৈধ দখলদারদের তালিকা প্রণয়ন করে ৩০ দিনের মধ্যে জনসমক্ষে প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন।

একই সঙ্গে আদালত নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় জলাধারের অবৈধ দখল ও দূষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার আদেশ জারি করেছেন। কালেক্টরেট হিসেবে আপনি (জেলা প্রশাসক) সেই ক্ষমতা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত। অবৈধ দখলদারদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের উচ্ছেদের আইনানুগ ক্ষমতা ও এখতিয়ার আপনারই। কিন্তু বিষয়টি আর এগোয়নি। কার্যকর উদ্যোগ নেই।  

২০২০ সালের ৩০ জুলাই নিজ ওয়েবসাইটে এসব দখলদারের তালিকাটি প্রকাশ করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। যশোর সদর উপজেলায় ভৈরব দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করার তালিকায় রয়েছে দলীয় কার্যালয়, বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র (ক্লিনিক), মার্কেট, পুকুর, বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বিজিবি ক্যাম্প ও বাসাবাড়ি।

যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্র দড়াটানা সেতু থেকে কাঠের পুল পর্যন্ত ভৈরব নদের ৮০০ মিটারের দুই তীরে অন্তত ২০টি বহুতল ভবনসহ ৫০ জনের বেশি প্রভাবশালী দখলদার রয়েছে।

যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্র দড়াটানা সেতু থেকে কাঠের পুল পর্যন্ত ভৈরব নদের ৮০০ মিটারের দুই তীরে অন্তত ২০টি বহুতল ভবনসহ ৫০ জনের বেশি প্রভাবশালী দখলদার রয়েছে। নদের প্লাবন ভূমিতে এসব স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। নদের এই অংশের সীমানা নির্ধারণ এবং অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করেনি জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। অথচ নদের ওই অংশ বাদ রেখে অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করে পশ্চিমাংশের ৮৪টি স্থাপনা এবং পূর্বাংশের সাড়ে তিন কিলোমিটারে ৫৯টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়। পরে এসব স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়।

বাঘারপাড়া উপজেলায় চিত্রা নদী দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে দলীয় কার্যালয়, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ, পুকুর, বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ি। নদীর অবৈধ দখলদারদের যে পূর্ণাঙ্গ তালিকা পাঠানো হয় তাতে ১২৬ জন দখলদারের নাম উল্লেখ করা হয়।

বাঘারপাড়া উপজেলায় চিত্রা নদী দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে দলীয় কার্যালয়, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ, পুকুর, বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ি। আংশিক তালিকায় এই নদীর ওপর ৪১টি অবৈধ দখলদার রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু পরে নদীর অবৈধ দখলদারদের যে পূর্ণাঙ্গ তালিকা পাঠানো হয় তাতে ১২৬ জন দখলদারের নাম উল্লেখ করা হয়।

এ ছাড়া আংশিক তালিকায় মনিরামপুর উপজেলার হরিহর নদ এবং মুক্তেশ্বরী, শ্রী ও হরি নদী দখল করেছে ১৬২ জন, ঝিকরগাছা উপজেলায় কপোতাক্ষ নদীর দুই পাশ দখল করে বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছে ৩০ জন, চৌগাছা উপজেলায় কপোতাক্ষ নদ দখল করেছে ৮০ জন এবং শার্শা উপজেলার বেতনা নদী ও হাকর নদী দখল করেছে ২২৪ জন।

আর অভয়নগর উপজেলায় ভৈরব নদ ৪৯ জন ও কেশবপুর উপজেলায় একটি খালের একজন দখলদারদের নাম তালিকায় রয়েছে।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) হিসাব অনুযায়ী অভয়নগর উপজেলায় ভৈরব নদের তীরে অবৈধ স্থাপনা ছিল ৮৬টি। এর মধ্যে যশোর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এবং বিআইডব্লিউটিএর সহযোগিতায় ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে দুই ধাপে ৫৯টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছিল। অবশিষ্ট ২৭টি স্থাপনা পর্যায়ক্রমে উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এর পর থেকে উচ্ছেদ অভিযান কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।

উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ থাকায় ভৈরব নদের জায়গা দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বাড়ছে। নদের জায়গা দখল করে নির্মাণ করা হচ্ছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। থেমে নেই দূষণ। দুটি ট্যানারি এবং বিভিন্ন কারখানার অপরিশোধিত রাসায়নিক বর্জ্য ভৈরব নদের পানি দূষিত করছে।

উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ থাকায় ভৈরব নদের জায়গা দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বাড়ছে। নদের জায়গা দখল করে নির্মাণ করা হচ্ছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। থেমে নেই দূষণ। দুটি ট্যানারি এবং বিভিন্ন কারখানার অপরিশোধিত রাসায়নিক বর্জ্য ভৈরব নদের পানি দূষিত করছে। দখল-দূষণে বদলে যাচ্ছে ভৈরবের আসল রূপ।

দখলদারদের তালিকা ঘেঁটে দেখা যায়, বেশির ভাগ স্থানীয় ব্যক্তি নদী-খাল দখল করে দোকানপাট, ঘরবাড়ি করেছেন। আর কপোতাক্ষ, ভৈরব, বেতনা, হাকর, নদ-নদীতে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান নদীর জায়গা দখল করে রেখেছে।

ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলন কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, ভৈরব দখল হয়ে গেছে। এতে নদের গতিপ্রবাহ থেমে গেছে। একসময় খুলনা থেকে যশোর শহরে সরাসরি নৌপথে পণ্য পরিবহন হতো। এখন সেখানে হেঁটে চলা যায়। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ভৈরব নদের অবৈধ দখলদারের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তা অপরিপূর্ণ। প্রকৃত অবৈধ দখলদারের সংখ্যা এর কয়েক গুণ বেশি। এসব অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করতে দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি নেই।

যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘নদ-নদীর অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে বিষয়টি একটি চলমান প্রক্রিয়া। ইতিমধ্যে ভৈরব নদের ১৪৩টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে জেলার অন্যান্য নদ-নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘তালিকাটি আংশিক। জেলার সব নদ-নদীর অবৈধ দখলদারদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করে তা উচ্ছেদ করা হবে।’