যশোরে ভিন্ন রকম পাঠচক্র

সপ্তাহে একটি বই পড়ি নামের সংগঠনের আয়োজনে ‘পারস্যপ্রতিভা’ বইয়ের পাঠচক্র করা হচ্ছে ফুলের রাজ্য যশোরের গদখালীতে
ছবি: প্রথম আলো

যশোর জেলা শিল্পকলা একাডেমির মুক্তমঞ্চের চারপাশে জ্বলছে মোমের আলো। কয়েকজন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক গোল হয়ে বসে উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ারের ট্র্যাজেডি নাটক হ্যামলেট নিয়ে আলোচনায় মেতেছেন। মাঝখানে গাঁদা ফুলের টব ও রজনীগন্ধার ডালা সাজিয়ে রাখা। বাঁশের তৈরি একটি ডালার ভেতরে ছোট ছোট শিঙাড়া। একজন নিয়ে আরেকজনের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। একটু পরে ধোঁয়া ওঠা লাল চায়ের পেয়ালা চলে এল হাতে হাতে।

হ্যামলেট বইটির ওপর যিনি বক্তব্য দিচ্ছেন, তাঁর নাম বিধান ভদ্র। যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।

‘সপ্তাহে একটি বই পড়ি’ নামে পাঠচক্রবিষয়ক একটি সংগঠনের সাপ্তাহিক আয়োজন এটি। প্রতি সপ্তাহে একটি বই পড়ে সেই বইয়ের লেখক, বিষয়বস্তু, চরিত্র, দর্শন, চেতনা নিয়ে চক্রের সবাই পর্যায়ক্রমে আলোচনা করেন। বইটির ওপর বিশেষ দখল থাকা একজন হন মুখ্য আলোচক।

পাশাপাশি আলোচ্য বইয়ের মূল ভাবের সঙ্গে মিল রেখে তৈরি করা হয় আলোচনার পরিবেশ। যেমন গত ২৪ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা উপন্যাসের ওপর আলোচনার দিনে পাঠচক্রের সদস্যরা চলে যান রবি ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ি যশোর-খুলনার সীমান্তে ফুলতলার দক্ষিণডিহিতে। সেখানে শ্বশুরবাড়িতে জামাই যাওয়ার মতো মাটির দুটি হাঁড়িতে পাকানো ও খেজুরের রসে ভেজানো চিতই পিঠা নিয়ে যাওয়া হয়। সেই পিঠার হাঁড়ি তুলে দেওয়া হয় বাড়ির ‘পাইক-পেয়াদা’দের হাতে। পাঠচক্রের সদস্যসহ আশপাশের বাসিন্দাদেরও ওই পিঠা পরিবেশন করা হয়। এর আগে পড়ন্ত বিকেলে কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত শ্বশুরবাড়ির আঙিনার সবুজ ঘাসের ওপর সবাই গোল হয়ে বসে ‘শেষের কবিতা’ বই নিয়ে আলোচনা করেন। সেদিন মুখ্য আলোচক ছিলেন যশোর সরকারি মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোফাজ্জেল হোসেন।

গত ২২ জানুয়ারি মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ রচিত পারস্যপ্রতিভা গ্রন্থের ওপর আলোচনার জন্য সংগঠনের সদস্যরা চলে যান যশোরের গদখালী ফুলের রাজ্যে। সেখানে গোলাপবাগানের পাশে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ওই গ্রন্থের ওপর আলোচনা করা হয়। আলোচনা হয় পারস্যের কবি জালাল উদ্দিন রুমি, শেখ সাদি, ওমর খৈয়াম, মহাকবি হাফেজ, শিরাজিদের জীবন ও দর্শন নিয়ে। মুখ্য আলোচক ছিলেন সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহজাহান কবীর।

সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের শহীদ আসাদ গেটের সামনে ‘নির্বাচিত’ নামে একটি বইয়ের দোকান রয়েছে। সেখানে পাঠচক্রের আসর বসে প্রতি শুক্রবার বিকেল চারটায়। বিশেষ বইয়ের পাঠচক্রের ক্ষেত্রে সদস্যরা যান বাইরে।

গত ২৯ এপ্রিল সংগঠনের ৩১তম পাঠচক্র হয়েছে। ওই দিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‌বিসর্জন গ্রন্থ নিয়ে সাহিত্য আলোচনা হয়।

২০২১ সালের ১ অক্টোবর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকঘর গ্রন্থ নিয়ে এই সংগঠনের পাঠচক্রের যাত্রা শুরু। এরপর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে নিকোলাই গোগলের তারাস বুলবা, রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী, সফোক্লিসের ইডিপাস, ফ্রানৎস কাফকার রূপান্তর, জন স্টাইনবেকের দ্য পার্ল, বুদ্ধদেব বসুর তপস্বী ও তরঙ্গিণী, ইস্কিলাসের দয়ালুরা, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত সুকান্তের শ্রেষ্ঠ কবিতা মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ বাংলা কবিতা, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের পালামৌ, ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মেরি শেলি, মোপাসাঁর শ্রেষ্ঠ গল্প, কাজী নজরুল ইসলামের রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম, বেগম রোকেয়ার অবরোধবাসিনী, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কপালকুণ্ডলা, হায়াৎ মামুদ অনূদিত গিলগামেশ ও শওকত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসি গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

‘সপ্তাহে একটি বই পড়ি’ নামে ফেসবুকে একটি পেজ রয়েছে। প্রতি আসরের ছবি ও সাহিত্য আলোচনা সেখানে পোস্ট করা হয়। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাইকেল মধুসূদন কলেজের সহকারী অধ্যাপক শাহজাহান কবীর। সংগঠনের নিয়মিত বইপড়া সদস্য আছেন ২০ জনের মতো। প্রতি মাসের চার সপ্তাহে চার ধরনের ৮০টি বই কিনে সদস্যদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সদস্যদের প্রতি আসরে চা-নাশতা দেওয়া হয়। এর জন্য সংগঠনের সদস্যদের কাছ থেকে কোনো ধরনের চাঁদা নেওয়া হয় না। শাহজাহান কবীর তাঁর চাকরির বেতনের টাকা থেকেই বই কেনা ও নাশতার খরচ জুগিয়ে থাকেন।

শাহজাহান কবীর বলেন, ‘এই পাঠচক্রের মধ্যেই জীবনের নির্মল আনন্দ খুঁজে পেয়েছি। আমাদের লক্ষ্য প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার একটি সুস্থ-সুন্দর পাঠক সমাজ গড়ে তোলা। কোনো ধরনের বিনিময়মূল্য ছাড়াই প্রতি সপ্তাহে সংগঠনের সদস্যদের হাতে একটি বই তুলে দেওয়া হয়। পড়া শেষে আবার ওই বই সংগ্রহ করা হয়।’

এই পাঠচক্রে অংশ নিয়েছেন যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘শিক্ষিত মানুষ হিসেবে সপ্তাহে কমপক্ষে একটি বই পড়া উচিত। “সপ্তাহে একটি বই পড়ি” সংগঠনের বই পড়ার এই অন্দোলনটা একটু ভিন্ন। বইয়ের মূল ভাবের সঙ্গে মিল রেখে পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে তারা পাঠচক্র করে। এতে পাঠকের মনে বিশেষ আগ্রহের সৃষ্টি হয়।’