যেন শহীদ মিনারের গ্রাম

মহান শহীদ দিবসে শিশুরা তৈরি করে শহীদ মিনার। গত রোববার কীর্তনখোলা নদীর তীরে রসুলপুর চরে
ছবি: প্রথম আলো

বরিশাল নগরের পাশ দিয়ে প্রবহমান কীর্তনখোলা নদীর তীরে জেগে ওঠা একটি চরের নাম রসুলপুর। এই চরের শিশুরাই নিজেদের চেষ্টায় ইট, কাঠ ও মাটি দিয়ে তৈরি করে ৩০টি শহীদ মিনার। তাদের হাতের স্পর্শে রঙিন হয়ে ওঠে এর বেদি ও পাদদেশ। লাল-সবুজ রঙের ছোঁয়ায় মূর্ত হয়ে ওঠে জাতীয় পতাকা। আলপনায় রঙিন হয়ে ওঠে মিনারের পাদদেশ। চরের শিশুরা এভাবেই পালন করল মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

গত রোববার সকাল থেকে রাত অবধি নানা কর্মসূচিতে মেতে থাকে চরের অন্তত ৩০০ শিশু। সঙ্গে ছিল তাদের অভিভাবকেরা। পুরো চরটি যেন শহীদ মিনারের গ্রামে পরিণত হয়ে উঠেছিল।

কীর্তনখোলা নদীর তীরে বিচ্ছিন্ন এক জনপদের নাম রসুলপুর। নদীর বাঁকে জেগে ওঠা এই চরের নাম রসুলপুর কলোনি (বস্তি)। এলাকাটি বরিশাল সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত। কয়েক বছর আগেও এই চরে শহীদ মিনার বলতে কিছু ছিল না। শিশুরাও জানত শহীদ মিনার কী এবং কেন। কিন্তু এখন সেই শিশুরা জানে শহীদ মিনার কাদের স্মৃতির উদ্দেশে নির্মিত, বাংলা ভাষার জন্য জীবন দেওয়া শহীদদের নাম। ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা, আর ভিন্নতর এক আবেগ নিয়ে এখন তারা শহীদ মিনার বানায়, ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়।

শিশুদের এই ব্যতিক্রমী আয়োজন দেখতে রোববার বিকেলে বরিশাল নগর থেকে অনেকে এই চরে যান। তাঁরা পিছিয়ে পড়া ওই জনপদের শিশুদের আয়োজন দেখে মুগ্ধ হন।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান সঞ্জয় সরকার বলেন,‘শহীদ মিনার আমাদের জাতিসত্তার প্রতীক। কয়েক বছর ধরে শুনছি, এই চরের শিশুরা শহীদ মিনার নির্মাণ করে। কিন্তু আজ (রোববার) দেখতে এসে সত্যিই আমি অভিভূত। এত সুন্দরভাবে শিশুরা প্রতিটি শহীদ মিনার তৈরি করেছে, দেখে আমি আপ্লুত।’

রোববার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, রসুলপুর কলোনির ঘিঞ্জি অলিগলির মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য শহীদ মিনার। মাটির বেদিতে কাঠ ও ইট দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে মিনার। কাঠের গুঁড়ার সঙ্গে রং মিশিয়ে লেখা হয়েছে ভাষাশহীদদের নাম। অঙ্কিত হয়েছে মানচিত্র। রঙিন কাগজে আবৃত করা হয়েছে শহীদ মিনার এলাকা। শিশু মৌমিতা (১২) বললো, মা-বাবার কাছ থেকে ৫-১০ টাকা চাঁদা তুলে তাঁরা শহীদ মিনার নির্মাণ করেছে।

চরের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাসদ নেতা মনীষা চক্রবর্তীর উদ্যোগে ২০১৪ সালে প্রথম শিশুদের নিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ প্রতিযোগিতা শুরু হয়। প্রথম দিকে সাত-আটটি শহীদ মিনার নির্মিত হতো। পর্যায়ক্রমে তা বাড়তে থাকে।

মনীষা চক্রবর্তী বলেন, ‘ভাষার প্রতি শিশুদের সচেতন করতেই এই উদ্যোগ নিই। আমরা দেখেছি, এই আয়োজনের মাধ্যমে এখানকার শিশুদের মধ্যে ভাষার প্রতি এক ভিন্ন রকমের আবেগ তৈরি হয়েছে।’

এ বছর শহীদ মিনার নির্মাণ প্রতিযোগিতার পাশাপাশি চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি, গান, নৃত্য ও অঙ্ক দৌড়ের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। ছিল বিনা মূল্যে চিকিৎসা ক্যাম্পের। আয়োজন করা হয় শিশুদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।