যৌতুক দিতে না চাওয়ায় সারা শরীরে ‘সিগারেটের’ ছ্যাঁকা

প্রতীকী ছবি

তাঁদের বিয়ে হয়েছে বছর সাতেক আগে। তখন তিনি কিশোরী। পারিবারিকভাবে ওই বিয়ের সময় স্বামীকে যৌতুক হিসেবে দেওয়া হয়েছিল ৫০ হাজার টাকা। তারপরও স্বামীর চাওয়া থেমে থাকেনি। ছোটখাটো যখন যা চাইতেন, তাঁর অনেক চাহিদাই মেয়েটি পূরণ করতেন বাবার বাড়িতে বলে। তবে এসব চাহিদা ছাড়িয়ে মেয়েটির ওপর অত্যাচারের খড়্গ নেমে আসে বছর দুয়েক ধরে। এ সময় সম্পর্কের মধ্যে তৃতীয় এক নারীর আবির্ভাব ঘটে। তৃতীয় ওই নারীর সঙ্গে সম্পর্কের কারণে স্ত্রীর ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায় স্বামীটির। সর্বশেষ ৫০ হাজার টাকা যৌতুক চেয়ে না পেয়ে স্ত্রীর গায়ে সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ওই স্বামীর বিরুদ্ধে।

রাজশাহী মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে আজ সোমবার সকালে এই কথাগুলো বলছিলেন ভুক্তভোগী নারী। ২২ বছরের ওই তরুণী ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, গত শুক্রবার সন্ধ্যায় মাছ রান্না করেছিলেন। রাতে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ভাত খেয়ে শুতে যাবেন এমন সময় ‘তৃতীয়’ ওই নারীটির ভিডিও কল আসে স্বামীর মুঠোফোনে। এ নিয়ে দু-এক কথা বলতেই তাঁকে কানসহ গালে সজোরে থাপ্পড় মারেন তাঁর স্বামী। পরে স্বামী তাঁকে বলেন, ‘৫০ হাজার টাকা এনে দিবি, নাইলে তুকে রাখব না।’ এ সময় তিনি ‘টাকা এনে দিতে পারব না’ বলামাত্রই মারধর শুরু হয়। এ সময় ‘তৃতীয়’ ওই নারীর সঙ্গে ভিডিও কল চলছিল, স্বামী নিজেই মারধরের চিত্র ওই নারীকে দেখাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে তরুণী অজ্ঞান হয়ে পড়েন।

শুক্রবার (১৬ অক্টোবর) রাত ১০টার দিকে তাঁর স্বামী ঘরের দরজা বন্ধ করে পরিবারের সদস্যদের প্ররোচনায় ৫০ হাজার টাকা যৌতুকের দাবি করেন। কিন্তু তিনি (স্ত্রী) টাকা দিতে অস্বীকার করায় তাঁকে সিগারেটের আগুন দিয়ে গলা, পেট, বুকসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছ্যাঁকা দেন ও মেরে জখম করেন। ওই সময় তিনি চিৎকার করলেও পরিবারের অন্য সদস্যরা তাঁকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেননি।

পরে দেড় ঘণ্টা পর তরুণীর জ্ঞান ফেরে। জ্ঞান ফিরে দেখেন, তাঁর সারা শরীরে সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়া হয়েছে। এ সময় শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ কেউ এগিয়ে আসেননি তাঁকে রক্ষায়। উল্টো তাঁরাই প্ররোচনা দিয়েছেন মারধরে। এ অবস্থা সহ্য করতে পারেননি তিনি। পরের দিন শনিবার (১৭ অক্টোবর) বাবার বাড়ির লোকজনের সহায়তা নিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার আগেই প্রথমে থানায় গিয়ে মামলা করেন। শনিবার বিকেলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন মামলায় স্বামী (২৫), শ্বশুর, শাশুড়ি ও ননদকে যৌতুক দাবি ও নির্যাতনের অভিযোগে আসামি করেছেন তিনি। পুলিশ পরদিন গত রোববার অভিযুক্ত স্বামীকে গ্রেপ্তার করে বিকেলে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে। তবে এ ঘটনায় অপর তিন আসামিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

ওই নারী আমাদের ওয়ার্ডে গত রোববার বিকেলে রেফার্ড হয়ে এসেছেন। তাঁর গায়ে অসংখ্য সিগারেটের ছ্যাঁকা রয়েছে। এ ধরনের পোড়ার ক্ষেত্রে শরীরের কত অংশ পুড়ে গেছে, তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। পুরোপুরি সুস্থ হতে সময় লাগবে।
আফরোজা নাজনীন, বিভাগীয় প্রধান, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগ

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত শুক্রবার (১৬ অক্টোবর) রাত ১০টার দিকে তাঁর স্বামী ঘরের দরজা বন্ধ করে পরিবারের সদস্যদের প্ররোচনায় ৫০ হাজার টাকা যৌতুকের দাবি করেন। কিন্তু তিনি (স্ত্রী) টাকা দিতে অস্বীকার করায় তাঁকে সিগারেটের আগুন দিয়ে গলা, পেট, বুকসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছ্যাঁকা দেন ও মেরে জখম করেন। ওই সময় তিনি চিৎকার করলেও পরিবারের অন্য সদস্যরা তাঁকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেননি।

ভুক্তভোগী এই তরুণীর বাবার বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কাঁকনহাট এলাকায়। আর তাঁর স্বামীর বাড়ি তানোর উপজেলার মাসিন্দা সইপাড়া গ্রামে। থানায় মামলা দায়েরের পর ওই তরুণীকে প্রথমে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়। এরপর সেখান থেকে তাঁকে রেফার করা হয় সেখানকার বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আফরোজা নাজনীন বলেন, ওই নারী তাঁদের ওয়ার্ডে গত রোববার বিকেলে রেফার্ড হয়ে এসেছেন। তাঁর গায়ে অসংখ্য সিগারেটের ছ্যাঁকা রয়েছে। এ ধরনের পোড়ার ক্ষেত্রে শরীরের কত অংশ পুড়ে গেছে, তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। পুরোপুরি সুস্থ হতে সময় লাগবে। প্রয়োজনীয় ওষুধ দিয়ে তাঁকে আজ সোমবার দুপুরে ছুটি দেওয়া হয়েছে।

তানোর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাকিবুল হাসান বলেন, এ ঘটনায় অভিযুক্ত স্বামীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বাকি আসামিরা পলাতক। তাঁদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।