রক্তাক্ত বুরহান বলছিলেন, ‘ভাই আমাকে বাঁচান’

বুরহান উদ্দিন

গুলিতে রক্তাক্ত সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির একটি দোকানের ভেতর ছটফট করতে করতে লোকজনের উদ্দেশে বলছেন, ‘ভাই, ভাই প্লিজ বাঁচান। প্লিজ বাঁচান। ভাই ভাই আমাকে বাঁচান।’

এ সময় পাশ থেকে একজন আরেকজনকে বলছেন, ‘কী সাংবাদিক সে, সে কিসের সাংবাদিক, সে বাদলের চামচা।’

গতকাল রোববার দুপুরের দিকে বুরহানের এই আকুতির ৩২ সেকেন্ডের একটি ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

গত শুক্রবার বিকেলে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চাপরাশিরহাট বাজারে মির্জা কাদের ও মিজানুর রহমান ওরফে বাদলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় গুলিতে বুরহান গুরুতর আহত হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত শনিবার রাতে তাঁর মৃত্যু হয়। বুরহান দৈনিক বাংলাদেশ সমাচার পত্রিকা ও ‘বার্তা বাজার’ নামের একটি অনলাইন পোর্টালের নোয়াখালী প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

কাদের মির্জা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই। তিনি বসুরহাট পৌরসভার মেয়র। আর মিজানুর রহমান কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। সংঘর্ষে জড়িত দুই পক্ষই বুরহানকে শুরুতে নিজেদের পক্ষের বলে দাবি করেন।

মিজানুর রহমান ওই ভিডিও চিত্র দেখে বুরহানের আকুতির বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেন।

মাত্র ২৫ বছর বয়সে তরুণ সাংবাদিক বুরহানের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না তাঁর বাবা নোয়াব আলী। অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক নোয়াব আলী আহাজারি করতে করতে বলেন, ‘কোথায় আমার ছেলে আমার লাশ কবরে দাফন করবে! আর আজ আমাকে আমার ছেলের লাশ দেখতে হলো। এই শোক আমি কীভাবে সইব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেন আমার ছেলের খুনিদের ফাঁসি নিশ্চিত করেন।’

বুরহানের বড় ভাই নুর উদ্দিন মোহাদ্দিস প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই কোনো দলের পক্ষ হয়ে কাজ করতে সেখানে যাননি। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গেছেন। তাই তাঁর ভাইয়ের মৃত্যু নিয়ে কেউ যাতে রাজনীতি না করেন। তিনি বলেন, তাঁর ভাইয়ের হত্যার ঘটনায় তাঁরা থানায় মামলা করবেন। প্রশাসন নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দেবে, এটাই তাঁদের আশা।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, চার বোন, তিন ভাইয়ের মধ্যে বুরহান ছিলেন পরিবারে সবার ছোট। সে কারণে সবার আদরেরও। বুরহানের চার বোনের সবারই বিয়ে হয়ে গেছে। বড় ভাই নুর উদ্দিন মোহাদ্দিস ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক। মেজ ভাই ফখরুদ্দীন মোবাচ্ছির সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।

নুর উদ্দিন মোহাদ্দিস জানান, ‘বুরহান ২০১৯ সালে নোয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে দর্শন বিষয়ে স্নাতক শেষ করে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের ইচ্ছা ছিল ছোট ভাই তাঁদের মতো পড়ালেখা করে চাকরি-বাকরি করবে। কিন্তু বছরখানেক আগে হুট করে সে সাংবাদিকতায় নাম লেখায়। বলে ভাই পড়ালেখার মধ্যেই সাংবাদিকতা চালিয়ে যাবে।’

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, গতকাল রাত আটটায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বুরহানের লাশ দাফন করা হয়েছে। জানাজায় বুরহানের সহকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ, রাজনৈতিক দলের নেতারাসহ সর্বস্তরের মানুষজন উপস্থিত ছিলেন।

সাংবাদিকদের বিক্ষোভ

দিনভর জেলার চাটখিল কোম্পানীগঞ্জ, সোনাইমুড়ীতে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন সাংবাদিকেরা। দুপুর ১২টায় জেলা শহরে নোয়াখালী প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন জেলায় কর্মরত সাংবাদিকেরা।

সাংবাদিক মাওলা সুজনের সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য দেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক বখতিয়ার শিকদার, আলমগীর ইউসুফ, আবু নাছের মঞ্জু, জামাল হোসেন, সুমন ভৌমিক, মোতাচ্ছিম বিল্লাহ, আকাশ মো. জসিম প্রমুখ। এ সময় কর্মসূচিতে সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য দেন উন্নয়ন সংগঠক আবদুল আউয়াল, নোয়াখালী বারের সাধারণ সম্পাদক ও রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি গুলজার আহমেদ।

সমাবেশে বক্তারা বলেন, দুই পক্ষের অপরাজনীতির নির্মম বলি হয়েছেন তরুণ সাংবাদিক বুরহান। এই নির্মম, নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত যে বা যাঁরাই থাকুক না কেন, তাঁদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।

এদিকে গত শনিবার সাংবাদিক বুরহানের মৃত্যুর পর তাঁকে কাদের মির্জা নিজের কর্মী বলে দাবি করেন। একইভাবে আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান দাবি করেন, বুরহান সাংবাদিক হলেও তাঁর অনুসারী ছিলেন। কাদের মির্জার সমর্থকেরা মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর শনিবার রাতেই বসুরহাটে বিক্ষোভ মিছিলও করেছেন। পরে অবশ্য গতকাল কাদের মির্জা বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলেন, সাংবাদিক বুরহান তাঁর কর্মী কিংবা লোক ছিলেন না। তিনি একজন নিরীহ সাংবাদিক। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে দোষীদের বিচার দাবি করেন তিনি।

বুরহানের মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল রাত পৌনে ১০টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত থানায় মামলা হয়নি।