রাঙা তরমুজে মলিন চাষি, সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিক্রির দাবি

খেত থেকে তরমুজ তুলে স্তূপ করে রেখেছেন চাষি। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলা পশ্চিম নেতা গ্রামে
প্রথম আলো

পটুয়াখালীতে মাঠের পর মাঠ তরমুজখেত। চারদিকে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে তরমুজ। খেত থেকে তরমুজ তুলে জড়ো করছেন চাষি। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মহাজনেরা তরমুজ কিনতে খেতে গিয়ে চাষিদের সঙ্গে দরদাম করে কিনছেন তরমুজ। তবে চাষিদের সেই হাসি এখন অনেকটা মলিন।

এদিকে বরগুনার আমতলী উপজেলায় তরমুজের বাম্পার ফলনে চাষিদের মুখে স্বপ্নের হাসি ফুটলেও লকডাউনের খবরে তা অম্লান হতে চলেছে। গত বছরের লোকসান কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখলেও লকডাউনের কারণে সে আশা ফিকে হয়ে গেছে তরমুজচাষি ও ব্যবসায়ীদের।

এখন চাষিরা তরমুজ কীভাবে বাজারজাত করবেন। এ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন তাঁরা। তবে গত বছর লকডাউনের সময় সরকারের পক্ষ থেকে কৃষকদের তরমুজ পরিবহন ও বাজারজাতকরণের সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। তরমুজচাষিরা এ বছরও লকডাউনের সময় পণ্য পরিবহনে যেন কোনো বাধা না আসে এবং ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে তরমুজ পৌঁছে দিয়ে বিক্রি করে আসতে পারেন, সরকারের কাছে সেই সুবিধা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পটুয়াখালী কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ বছর জেলায় ১৪ হাজার ২৩৬ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি তরমুজ চাষ হয়েছে রাঙ্গাবালী উপজেলায়। রাঙ্গাবালীতে ৭ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে। এ ছাড়া গলাচিপায় ৫ হাজার হেক্টর, কলাপাড়ায় ৬১০ হেক্টর, বাউফলে ৯০০ হেক্টর, দশমিনায় ১৫০ হেক্টর, সদর উপজেলায় ২৬৮ হেক্টর, মির্জাগঞ্জে ৫ হেক্টর ও দুমকি উপজেলায় ৩ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে। উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৯৮ হাজার ২৬০ মেট্রিক টন। উৎপাদিত তরমুজের বাজার বিক্রিমূল্য ১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন কৃষি বিভাগ।

তরমুজচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ বছর তরমুজের ফলন ভালো হয়েছে। গত বছরের চেয়ে এ বছর আবাদ বেশি ও আকারে অনেক বড় হওয়ায় তরমুজচাষিরা খুব খুশি। তবে লকডাউনে তরমুজ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছাতে না পারলে বিক্রি কমে যাবে, দামও পড়ে যাবে। লোকসানের মুখে পড়বেন কৃষক।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, পটুয়াখালীর উপপরিচালক কৃষিবিদ এ কে এম মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর তরমুজের উৎপাদান ভালো হবে বলে মনে করা হচ্ছে। মৌসুমের আবাদের পর আবহাওয়া অনুকূলে ছিল। তাই ফলন ভালো হয়েছে। তিনি বলেন, এ অঞ্চলে দোঁআশ মাটিতে তরমুজের ফলন ভালো হয়। এ ছাড়া দিনের বেলা প্রখর রোদে তরমুজের রং উজ্জ্বল ও সুস্বাদু হয়। ফলে এ অঞ্চলের তরমুজ খুব সুস্বাদু এবং ক্রেতাদের কাছেও এই সুস্বাদু ফলটি জনপ্রিয়।

লকডাউনে উৎপাদিত তরমুজ নিয়ে কৃষকদের ক্ষতির আশঙ্কা প্রসঙ্গে এ কে এম মহিউদ্দিন বলেন, জেলায় ইতিমধ্যে ৭০ শতাংশ তরমুজ খেত থেকে তোলা হয়েছে এবং তা ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে গেছে। তবে এখনো খেতে যে তরমুজ রয়েছে, তা যাতে বিভিন্ন স্থানে পাঠাতে পারে এ ব্যাপারে কৃষি বিভাগ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের কথা বলেন তিনি।

আমতলী কৃষি কার্যালয়ে সূত্রে জানা গেছে, এ বছর আমতলীতে তরমুজের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৯৯০ হেক্টর। ওই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। গত বছর তরমুজ চাষ হয়েছিল ১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। গত বছরের তুলনায় এ বছর ৪৯০ হেক্টর জমিতে তারমুজ আবাদ বেশি হয়েছে। এ বছর তরমুজের বাম্পার ফলন হয়েছে। বাজারে ভালো দাম থাকায় বিগত বছরের লোকসান কাটিয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখছিলেন চাষিরা। করোনা পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হওয়ায় আগামীকাল সোমবার থেকে দেশব্যাপী সাত দিনের লকডাউন ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এ লকডাউনের ঘোষণায় আমতলীর তরমুজচাষিরা হতাশ। লকডাউনে এ অঞ্চলের তরমুজ ঢাকা, গাজীপুর, বগুড়া, কুমিল্লা, গাইবান্দা, টাঙ্গাইল, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে ধারণা করছেন চাষি ও পাইকারী ব্যবসায়ীরা।

আমতলীর আঠারোগাছিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম সোনাখালী গ্রামের তরমুজচাষি আলমগীর আকন বলেন, ‘লকডাউনে গত বছর তরমুজ কম দামে বিক্রি করেছি। বিক্রি করতে না পারায় অনেক তরমুজ খেতেই নষ্ট হয়েছে। এ বছর এমন অবস্থা হলে সরকারি ব্যবস্থাপনায় তরমুজ বিক্রির দাবি জানান তাঁরা।’

কুকুয়া ইউনিয়নের চুনাখালী গ্রামের ওহাব মৃধা, বাহাউদ্দিন হাওলাদার ও রাজ্জাক মৃধা বলেন, গত বছর লকডাউনে পাইকার এসেও তরমুজ ক্রয় করেনি। তাই কম দামে বিক্রি করতে হয়েছে। এ বছরও লকডাউন থাকলে তরমুজ নিয়ে বিপাকে পড়তে হবে।
আমতলী গাজীপুর বন্দরের তরমুজ ব্যবসায়ী সোহেল রানা বলেন, ‘লকডাউন থাকলে পরিবহন সমস্যায় দূরদূরান্ত থেকে ব্যাপারীরা তরমুজ কিনতে আসবেন না। এতে স্থানীয় বাজারে তরমুজের চাহিদা কমে যাবে। ফলে দামও কমবে। সব মিলিয়ে তরমুজ নিয়ে চাষিরা ভীষণ সমস্যায় পড়বেন। লকডাউনের খবর শুনে খেত থেকে তরমুজ কাটা বন্ধ করে দিয়েছি।’

আমতলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, লকডাউনে তরমুজ পরিবহন ও বিক্রিতে সমস্যা হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে আমতলীর তরমুজ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হবে। কৃষকেরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেই দিকে যথাযথ খেয়াল রাখা হবে।