রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন থেকেই গণধর্ষণ, কলঙ্কিত ক্যাম্পাস

এমসি কলেজে তরুণী গণধর্ষণের ঘটনা নিয়ে সিলেটের চার বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেছেন, ১২৮ বছরের প্রাচীন সিলেট এমসি কলেজে এক দশক ধরে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা একের পর এক অপকর্ম করে চলছেন। কোনো ঘটনার সঠিক বিচার না হওয়ায় গণধর্ষণের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটানোর সাহস তাঁরা পেয়েছেন।

মো. আবদুল আজিজ

‘কয়েক বছর ধরে একের পর এক ন্যাক্কারজনক ঘটনা এমসি কলেজে ঘটছে। এটি খুবই দুঃখজনক। আমরা যখন শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছি, তখন কলেজে এ রকম শিক্ষার্থী তৈরি হয়নি। এসব শিক্ষার্থী ও দুর্বৃত্তপনা সময়ের সৃষ্টি। তবে জনসচেতনতা তৈরি করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। তাহলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।’

সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গত শুক্রবার রাতে তরুণীকে গণধর্ষণের ঘটনায় এভাবেই নিজের প্রতিক্রিয়া জানালেন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও ভাষাসংগ্রামী মো. আবদুল আজিজ। তিনি সিলেট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটিরও সাবেক উপাচার্য। সিলেটের প্রবীণ এই শিক্ষাবিদ মনে করেন, ক্যাডারভিত্তিক রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ভাঙতে পারলেই এসব ঘটনা ঘটানোর সাহস পাবেন না ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের উদ্যোগী হতে হবে।

এমসি কলেজে গণধর্ষণের ঘটনা নিয়ে শিক্ষাবিদ আবদুল আজিজ ছাড়াও সিলেটের তিন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথম আলোর এই প্রতিনিধি। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, ১২৮ বছরের প্রাচীন সিলেট এমসি কলেজে এক দশক ধরে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা একের পর এক অপকর্ম করে চলেছেন। এর মধ্যে ছাত্রাবাস পোড়ানো, আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে শিক্ষার্থী খুন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের লাঞ্ছনা, ছাত্রীদের ইভটিজিং, সাংবাদিকের ওপর হামলা, ক্যাম্পাসে ছিনতাই, ছাত্রাবাসে মাদক ও জুয়ার আসর বসানো উল্লেখযোগ্য। কোনো ঘটনার সঠিক বিচার না হওয়ায় গণধর্ষণের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটানোর সাহস তাঁরা পেয়েছেন।

নিতাই চন্দ্র চন্দ

এমসি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ নিতাই চন্দ্র চন্দ বলেন, ‘গণধর্ষণের ঘটনাটি কলেজের জন্য বড় ধরনের এক কলঙ্ক। যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা আগে থেকেই চরম বেয়াদব ও দুষ্টু ছিল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, কলেজে টুকটাক যা–ই ঘটুক না কেন, ছাত্রাবাসে অন্তত কোনো অপকর্ম ঘটবে না। কিন্তু সেই বিশ্বাস ভাঙচুর হয়ে গেল গত শুক্রবারের বর্বরোচিত ঘটনায়। আমি থাকাবস্থায় কিছুদিন পরপর ছাত্রাবাসে থাকা শিক্ষার্থীদের নিয়ে বৈঠক করেছি। যা–ই হোক, সেটা ভিন্ন কথা। এখন ছাত্রাবাস বন্ধ। এ সময়ে এই দুষ্টুগুলো এখানে থাকে কীভাবে? এটাও খতিয়ে দেখা দরকার।’

নিতাই চন্দ্র চন্দ ২০১৪ সালের ২৭ মে থেকে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন। ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ছাত্রাবাস আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার চেয়েও ছাত্রলীগের কর্মীরা ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়ে শত গুণ ভয়াবহ অপকর্ম ঘটিয়েছে। আমাদের কলেজের ছাত্রাবাসে এমন ধরনের কোনো ঘটনা ঘটতে পারে, সেটা কল্পনাতেও ছিল না।’

ফারুক মাহমুদ চৌধুরী

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী মনে করেন, এ ঘটনার দায় কলেজ কর্তৃপক্ষ ও ধর্ষকদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারা এড়াতে পারেন না। তিনি বলেন, এমসি কলেজে, বিশেষ করে এক দশক ধরে একটার পর একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। সর্বশেষ যে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটল, এতে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হতে তো হবেই, পাশাপাশি এর পেছনে যাঁরা তাঁদের গডফাদার রয়েছেন, তাঁদেরও চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। তা না হলে এই দুর্বৃত্তপনা চিরতরে নির্মূল হবে না। কারণ, এই গডফাদাররাই এদের লালন-পালন করেন, প্রশ্রয় দেন।

ফারুক মাহমুদ আরও বলেন, ‘এসব গডফাদারদের হাত অনেকখানি লম্বা। এ জন্যই নানা অপকর্ম করা সত্ত্বেও কেউ তাদের কিছু করতে পারেন না। আমরা মনে করি, এই মামলায় কলেজ অধ্যক্ষ ও ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়ককেও সংযুক্ত করতে হবে। তাঁদেরও গ্রেপ্তার করা উচিত। কারণ, ছাত্রাবাস চালু থাকার দায় তাঁদেরই। এই ছাত্রাবাস করোনাকালেও চালু থাকায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা অপকর্ম করতে পেরেছে। কোনোভাবেই কলেজ কর্তৃপক্ষ এর দায় এড়াতে পারে না।’

মো. আরশ আলী

সিলেটের বাসিন্দা গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মো. আরশ আলী এ ঘটনার জন্য বিচারের পূর্বের অপকর্মের বিচার না হওয়াকেই দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, ছাত্রাবাস পোড়ানোর ঘটনার বিচার এখন পর্যন্ত হয়নি। কলেজটি ঘিরে একের পর এক অপকর্ম হলেও বিচার হয়নি। এর ফলে দুর্বৃত্তরা তরুণীকে ধর্ষণের সাহস করতে পেরেছে। শিগগিরই কলেজের সব কটি অসভ্য ও দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কলেজ কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর হওয়া প্রয়োজন।

ভবিষ্যতে কলেজে কোনো অপকর্মের ঘটনা না ঘটে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার তাগাদা দিয়ে প্রবীণ এই রাজনীতিক বলেন, ‘গণধর্ষণের ঘটনায় সিলেটবাসী লজ্জিত ও বিব্রত। এর নিন্দা জানানোরও কোনো ভাষা আমার কাছে নেই। আমি ক্ষুব্ধ, একই সঙ্গে হতবাকও। এমন ঘটনাও সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এই কলেজে ঘটতে পারে, এটা কল্পনাও করতে পারি না।’