রাতে সন্দ্বীপ বিচ্ছিন্ন, মুমূর্ষু রোগী নিয়ে বিপাকে স্বজনেরা
দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে যাতায়াত কেবল নৌপথে। এ পথে রাতে যাত্রীবাহী কোনো নৌযান চলে না। তাই রাতে প্রসূতি ও মুমূর্ষু রোগীদের নিয়ে বিপাকে পড়েন সন্দ্বীপের মানুষ।
উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, সংকটাপন্ন রোগীদের দ্রুত চট্টগ্রাম নগরে নিয়ে যেতে দুই দফায় দুটি সি অ্যাম্বুলেন্স দেয় সরকার। এর মধ্যে একটি এক বছর কোনো রকম চলেছিল। অন্যটি এক দিনের জন্যও ব্যবহৃত হয়নি। দীর্ঘদিন ফেলে রাখার কারণে অ্যাম্বুলেন্স দুটি পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে রোগীদের চট্টগ্রাম নগরে নিয়ে যেতে সরকারি কোনো ব্যবস্থা না থাকায় নির্ভর করতে হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নৌযান লাইফবোট কিংবা মালবাহী ট্রলারের ওপর।
গত সোমবার রাতে এক নারী অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে চিকিৎসকেরা দ্রুত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দেন। রাত ১০টার দিকে ঘাটে এসে কোনো নৌযান না পেয়ে হতাশ হন রোগীর স্বজনেরা। পরে প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে লালবোটে করে রাত পৌনে ১১টার দিকে চমেক হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হন। এর এক দিন আগে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুই কিশোর আহত হয়। বিকেলে তাদের চমেক হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু নৌযান না থাকায় পরদিন সকালে জাহাজে করে চট্টগ্রামে আনা হয় তাদের।
২০ এপ্রিল সন্দ্বীপ উপকূলে ২২ যাত্রী নিয়ে যাওয়ার সময় ঝড়ের কবলে পড়ে একটি স্পিডবোট ডুবে যায়। এতে একই পরিবারের তিনজনসহ চার শিশু মারা যায়। এর এক দিন পর থেকে সন্দ্বীপের স্পিডবোট চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রশাসন সূত্র জানায়, সন্দ্বীপের মুমূর্ষু রোগীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ কিংবা ঢাকা নিতে হয়। এ জন্য সন্দ্বীপ থেকে মূল ভূখণ্ডে সন্দীপ চ্যানেলের কুমিরা–গুপ্তছড়া নৌপথ পাড়ি দিয়ে যেতে হবে। এ পথে লোকজন এত দিন বিআইডব্লিউটিসির যাত্রীবাহী জাহাজ, সার্ভিস ট্রলার ও স্পিডবোট দিয়ে যাতায়াত করত। দুর্ঘটনা হলে রাতেই স্পিডবোট কিংবা লাইফবোটে করে রোগীদের চট্টগ্রামের হাসপাতালে নেওয়া হতো। কিন্তু ২০ এপ্রিল সন্দ্বীপ উপকূলে ২২ যাত্রী নিয়ে যাওয়ার সময় ঝড়ের কবলে পড়ে একটি স্পিডবোট ডুবে যায়। এতে একই পরিবারের তিনজনসহ চার শিশু মারা যায়। এর এক দিন পর থেকে সন্দ্বীপের স্পিডবোট চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, ২০০৮ সালে ১৭ এপ্রিল ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে সন্দ্বীপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে রোগী পরিবহনের জন্য একটি সি অ্যাম্বুলেন্স দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অ্যাম্বুলেন্সটি জনবল ও জ্বালানিসংকটে তিন বছর বন্ধ ছিল। ২০১১ সালে উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে অস্থায়ীভাবে একজন চালক ও জ্বালানি তেলের ব্যবস্থা করে সি অ্যাম্বুলেন্স চালানোর ব্যবস্থা করা হয়। এক বছর চলার পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। আর এক দিনের জন্যও সেটি চলেনি। পরে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ অ্যাম্বুলেন্সটি উপকূল থেকে তুলে এনে হাসপাতালের পেছনে ফেলে রেখেছে।
এ ছাড়া ২০১৫ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে উপজেলা প্রশাসনকে আরও একটা সি অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়। সেটিও এক দিনের জন্য রোগী পরিবহনের ব্যবহৃত হয়নি। সেটি বর্তমানে গুপ্তছড়া ঘাটের জেটির পাশে পড়ে রয়েছে। দুটি অ্যাম্বুলেন্সই এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে।
তবে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, এই অ্যাম্বুলেন্স দুটি সাধারণত হাওড় অঞ্চলে চলার উপযোগী। বর্ষাকালে সন্দ্বীপ চ্যানেলে বড় বড় ঢেউয়ে এ অ্যাম্বুলেন্স চলাচলের অনুপযোগী। ফলে যেকোনো মুহূর্তেই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
সন্দ্বীপে নিরাপদ নৌ যাতায়াতের জন্য আন্দোলনকারীদের একজন খাদেমুল ইসলাম বলেন, রাতে সন্দ্বীপ মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সরকারের উচিত দ্রুত এ নৌপথে চলাচল উপযোগী একটি সি অ্যাম্বুলেন্স, তার জন্য দক্ষ চালক ও জ্বালানির ব্যবস্থা করা। অন্যথায় জরুরি অবস্থায় নৌবাহিনী কিংবা কোস্টগার্ডে দ্রুতগামী জলযান রোগীদের স্বার্থে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ারও ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ছাড়া এ নৌপথের সব বয়াবাতিকে সচল করার দাবি জানান তিনি।
এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলুল করিম বলেন, যেহেতু সন্দ্বীপ চ্যানেলে বড় ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়, সেহেতু এখানে দক্ষ অ্যাম্বুলেন্স চালকের প্রয়োজন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাঁরা কোনো অ্যাম্বুলেন্স চালক পদায়ন করেননি এবং জ্বালানির কোনো ব্যবস্থা হয়নি। তাই অ্যাম্বুলেন্সটি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। যন্ত্রাংশ চুরি হওয়া অথবা ঘূর্ণিঝড়ে হারিয়ে যেতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে তাঁরা সি অ্যাম্বুলেন্সটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এনে রেখেছেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সম্রাট খীসা প্রথম আলোকে বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে অ্যাম্বুলেন্সটি সন্দ্বীপের জন্য দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটি সন্দ্বীপ চ্যানেলে চলাচলের জন্য উপযোগী নয়। তা ছাড়া জনবল ও জ্বালানির না দেওয়ার কারণে ২০১৬ সালে সেটিকে ফেরত নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসনকে চিঠি দেয় উপজেলা প্রশাসন। গত ছয় বছরেও অ্যাম্বুলেন্সটি ফেরত নেওয়া হয়নি।