রায়ে স্বস্তি এসেছে পরিবারে, স্বাভাবিক হতে পারেনি শিশুরা

পুলিশ ভ্যানে তোলার সময় বরিশাল আদালত চত্বরে এক শিশুর আহাজারি। গত বছরের ৭ অক্টোবর
ফাইল ছবি

‘অগো জীবনের উপরে দিয়া যে ঝড় গ্যাছে হেইয়ার ধকল এহনো শ্যাষ অয় নায়। এখনো রাইতে ঘুমের মধ্যে প্রায়ই চিক্কইর দিয়া ওডে। কয় ‘‘নেলে নেলে, আব্বা মোরে ধইর‌্যা নেলে।’’ এইরপর বালিশ ধইর‌্যা কাঁপতে থাহে।’

বরিশালের বাকেরগঞ্জের একটি গ্রামের ৯ বছরের শিশু আজাদের (ছদ্মনাম) বাবা জানাচ্ছিলেন ছেলের অস্বাভাবিক এই আচরণের কথা। একই গ্রামের প্রতিবেশী ছয় বছর বয়সী এক শিশুকে কথিত ধর্ষণ মামলায় গত বছরের ৭ অক্টোবর গ্রেপ্তার হয়েছিল আজাদ। আজাদের সমবয়সী আরও তিন শিশু একই ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়। তাঁদের কারও মানসিক অবস্থা এখনো স্বাভাবিক হয়নি।

গ্রেপ্তার করে থানায় নেওয়ার পর ওই শিশুদের বরিশাল সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নির্দেশে যশোর পুলেরহাট শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে নেওয়ার জন্য পুলিশ ভ্যানে তোলার সময় আদালত চত্বরে ওই শিশুদের কান্না আর আজাহারিতে গোটা আদালত প্রাঙ্গণে এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

বিষয়টি গণমাধ্যমের খবর হওয়ার পর ৮ অক্টোবর রাতে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি আদেশ দেন। আদালতের নির্দেশে ৯ অক্টোবর সকালে ওই চার শিশুকে বাড়িতে অভিভাবকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, বাকেরগঞ্জ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) এবং ওই চার শিশু, তাদের অভিভাকদের উচ্চ আদালতে সশরীর উপস্থিত হওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

এ ঘটনার প্রায় আট মাস পর উচ্চ আদালত গতকাল রোববার ওই রুলের নিষ্পত্তি করেন। রায়ে বাকেরগঞ্জ থানার তৎকালীন ওসি মো. আবুল কালামসহ সাত পুলিশ সদস্য ও সমাজসেবা কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. এনায়েত উল্লাহর ফৌজদারি বিচারিক ক্ষমতা প্রত্যাহার করে তাঁকে দেওয়ানি মামলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। রায়ে চার শিশুর বিরুদ্ধে করা মামলাটি আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত বলে বাতিল ঘোষণা করা হয়। আইনজীবীরা বলছেন, ৯ বছরের নিচে কোনো শিশু অপরাধী গণ্য হতে পারে না। এ ছাড়া ভুক্তভোগী শিশুর বক্তব্য ও মেডিকেল রিপোর্টে ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ফলে মামলাটি বাতিল হয়েছে।

গত বছরের অক্টোবরে বরিশাল আদালত চত্বরে ভুক্তভোগী চার শিশু
ফাইল ছবি

হাইকোর্টের এই রায়ে চার শিশুর পরিবারে স্বস্তি ফিরেছে। আইনজীবীর মাধ্যমে রায়ের খবর পেয়েছেন আজাদের বাবা। তিনি আজ সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত দিন ডরে মোরা কারও লগে এই সব ব্যাপার লইয়্যা কোনো কথাবার্তা কই না। মোরা গরিব মানুষ, কেডা আবার কোন মামলায় মোগো ফাঁসাইয়্যা দেয়।’ আজাদ স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে বলে জানান তিনি।

একই আতঙ্ক বাকি তিন শিশুর পরিবারেও। এই মামলার প্রধান আসামি ছিল আট বছরের এক শিশু। ওই ঘটনার পর তাকে ঢাকায় রাখা হয়েছে। সেখানেই পড়াশোনা করছে। তার বড় ভাই পেশায় রাজমিস্ত্রি। তিনিই এখন সংসার চালান। রায়ের কথা টেলিভিশনে শুনেছেন উল্লেখ করে শিশুটির ভাই বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। ছোট ভাইটা ওই ঘটনার পর এখনো আতঙ্কে কারও লগে মেলে না। সব সময় চুপচাপ থাহে।’ শিশুটির বাবা বলেন, ‘কখন আবার নতুন মামলায় বাচ্চাটারে জড়ায়, হেই ভয়ে পোলারে ঢাকায় পাঠাইছি। হাইকোর্ট অগো বাড়িতে পৌঁছে দেওনের পর যে কয় দিন বাড়ি ছিল ভয়ে ঘর দিয়া বাইর অইতো না। ঘরের মধ্যেই থাকত হারা দিন। রাত অইলে ডরে কইতো ‘‘মা পুলিশ আইছে।’’ শেষে ঢাকায় পাঠিইছি।’

এতটুকু বাচ্চাদের মনের ওপর যে প্রচণ্ড চাপ পড়েছে, তা থেকে স্বাভাবিক হওয়া খুব কঠিন হবে। তাদের যেমন সুস্থ পরিবেশে প্রতিপালন করতে হবে, তেমনি উদ্ভূত পরিস্থিতির পর চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
শাহ সাজেদা, সভাপতি, সচেতন নাগরিক কমিটির বরিশাল জেলা শাখা

অন্য দুই শিশুর পরিবারের সঙ্গে আলাপেও একই ধরনের চিত্র পাওয়া গেছে। এক শিশুর বাবা বলেন, ‘হুনছি হাইকোর্ট আবার রায় দেছে। এহন একটু মনডায় সাহস পাইছে। কিন্তু পোলা আগের মতোন আর হাসিখুশি নাই।’

এলাকাবাসী বলছে, ঘটনার পর বাড়িতে ফিরে আসা চার শিশুর জীবনের উচ্ছলতা থেমে গেছে। এখন বাড়িতে শান্ত, চুপচাপ থাকছে।

সচেতন নাগরিক কমিটির বরিশাল জেলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন বলেন, এই শিশুদের মানসিকভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা খুব দুঃসাধ্য। কারণ, এতটুকু বাচ্চাদের মনের ওপর যে প্রচণ্ড চাপ পড়েছে, তা থেকে স্বাভাবিক হওয়া খুব কঠিন হবে। তাদের যেমন সুস্থ পরিবেশে প্রতিপালন করতে হবে, তেমনি উদ্ভূত পরিস্থিতির পর চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। শিশুরা যদি ট্রমার মধ্যে থাকে, তাহলে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা থেকেই যাবে। হাইকোর্টের এই রায়কে দৃষ্টান্তমূলক এবং শিশু অধিকারের মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করেন।

তবে বাতিল হওয়া মামলাটির বাদী রায় প্রসঙ্গে বলেন, ‘এখন আদালত রায় দিয়েছেন, আমার তো কিছু করার নেই। তবে আমি সঠিক বিচার পাইনি। আগে শুনতাম সত্য চাপা পড়ে, এখন নিজেই তার ভুক্তভোগী। এর বেশি কিছু আমার বলার নেই।’

ভুক্তভোগী পরিবার ও এলাকাবাসীর ভাষ্য, বাদী ও বিবাদীর পরিবার পরস্পরের আত্মীয়। তাঁদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ১৫ শতাংশ জমি নিয়ে বিরোধ চলে আসছিল। এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে বেশ কয়েকবার সালিসও হয়েছে। সর্বশেষ ৪ অক্টোবর দুই পরিবারের ঝগড়ার সূত্র ধরে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন ওই মামলার বাদীপক্ষের লোকজন। তার দুই দিনের মাথায় থানায় ধর্ষণ মামলা হয়।