রিকশার সঙ্গে পুড়ে গেল স্বপ্নও

উত্তেজিত জনতার দেওয়া আগুনে বসতঘরের সঙ্গে পুড়েছে রিকশাভ্যান। এখনো সেখানে পড়ে আছে পুড়ে যাওয়া রিকশার অবকাঠামো। সেই রিকশার অবকাঠামো সরানোর চেষ্টা করছেন নন্দ রানী। বুধবার দুপুরে তোলা
ছবি: আলতাফ হোসেন

রংপুর নগরে ভাড়ায় রিকশা চালাতেন পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া গ্রামের বড়করিমপুর এলাকার পরিতোষ চন্দ্র রায় (৪০)। কিন্তু ইজিবাইকের দৌরাত্ম্যে পায়ে প্যাডেল মেরে চালানো সেই রিকশায় যাত্রীরা উঠতে চাইতেন না। এতে তাঁর আয় অনেক কম হতো। এরপরও দিনভর যা আয় হতো, তার অর্ধেক মালিককে দিয়ে বাকি টাকা নিয়ে ঘরে ফিরতেন তিনি।

সেই আয়ে অতি কষ্টে চলত পরিতোষের সংসারের খরচ ও দুই সন্তানের লেখাপড়া। তপ্ত রোদে পরিতোষ রিকশা চালাতেন আর স্বপ্ন দেখতেন; কবে নিজের একটি রিকশাভ্যান হবে। তাঁর সেই স্বপ্ন ১৫ দিন আগে পূরণ করেছিলেন স্ত্রী নন্দ রানী। বেসরকারি এনজিও গার্ক থেকে সাপ্তাহিক কিস্তিতে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে স্বামীকে একটি চকচকে ব্যাটারিচালিত নতুন রিকশাভ্যান কিনে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে সেই রিকশা পুড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুড়ে গেছে স্বপ্নও।  

পরিতোষ বলেন, ‘ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গত রোববার রাতে উত্তেজিত জনতা হিন্দু গ্রামে হামলা, লুটপাট ও আগুন লাগিয়ে দিলে অন্যদের মতো আমার বাড়িঘর ও রিকশাভ্যানটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ৪১ হাজার টাকায় কেনা রিকশাভ্যানটি মাত্র ১০ দিন চালিয়েছি। ১ হাজার ৩৫০ টাকার দুটি কিস্তিও দিয়েছি। এতে ভালোই চলছিল দিন। কিন্তু গত রোববার সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। আগুনে সব হারিয়েছি।’

পরিতোষের স্ত্রী নন্দ রানী বলেন, ‘কপালে সুখ সইলো না। স্বামীর স্বপ্ন পূরণে ঋণ নিয়ে রিকশাভ্যান কিনে দিয়েছিলাম। এখন ভ্যান না থাকলেও ঋণের বোঝা মাথার ওপরে আছে। তা পরিশোধ করতে হবে। ওরা (উত্তেজিত জনতা) আমার সাজানো–গোছানো ঘরদোর, সংসার আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। স্বামী, শিশু দুই সন্তান নিয়ে এখন আমার কী হবে? কোথায় পাব টাকা? ঋণ পরিশোধ বা প্রতি সপ্তাহে কিস্তি দিব কীভাবে? এর চাইতে মরণটায় ভালো ছিল।’

নিজের জমানো টাকা ও এনজিও থেকে ৩২ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ওই গ্রামের অর্চনা রায়ও স্বামী স্বপন চন্দ্রকে একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা কিনে দিয়েছিলেন। তা চালিয়ে ঋণ শোধ করে দিনবদলের স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। রিকশার আয়ের টাকায় ঋণের ২০টি কিস্তিও পরিশোধ করেছিলেন। এখনো কয়েকটি কিস্তি বাকি রয়েছে। তাঁর বসতঘর জ্বালিয়ে দিয়ে ওই রাতে সেই রিকশাটিও নিয়ে গেছে।

অর্চনা রানী বলেন, ‘যখন হামলাকারীরা বাড়ির দরজায় আসে, তখন ঘরে ছিলাম। দরজায় তখন অনেক মানুষের শোরগোল। দরজা দিয়ে ভয়ে বের হতে পারছিলাম না। পরে জীবন বাঁচাতে বেড়ার টিন কেটে কোনোমতে বেরিয়ে পাশের ধানখেতের ভেতরে লুকিয়ে থাকি। সেখান থেকে দেখি ঘর আগুনে দাউদাউ করে জ্বলছে। তখন বুকটাও জ্বলে–পুড়ে ছারখার হয়ে গেলেও কিছুই করতে পারিনি। সকালে এসে দেখি শুধু ছাই। রিকশাটা তারা (হামলাকারীরা) নিয়া গেছে। এখন চলার উপায় নাই। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, এমন রাইত যেন আর না আইসে।’

শুধু অর্চনা রানী ও নন্দ রানীই নয়, ধর্ম অবমাননার অভিযোগে হিন্দুপল্লিতে উত্তেজিত জনতার হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারের চোখে–মুখে এখনো আতঙ্ক, হতাশা আর দুর্দশার ছাপ বিদ্যমান।