রূপসা ঘাটের ‘বেকার মাঝিরা’ এক দিন তিন বেলা খেলে পরের দিন অবস্থা কাহিল

অভাব-অনটন আর বিষাদকে নিত্যদিনের সঙ্গী করে এখনো রূপসার বুকে রয়ে গেছেন সিরাজ
ছবি: প্রথম আলো

সময়টা মুক্তিযুদ্ধের বেশ কয়েক বছর আগের। মাদারীপুর সদরের কুনিয়া এলাকা থেকে মা ও ভাইদের সঙ্গে খুলনা আসেন সিরাজ। বয়স তখন তাঁর নয় কি দশ হবে। আড়িয়াল খাঁ পাড়ের কুনিয়া এলাকার অনেকেই তখন জীবিকার তাগিদে রূপসা ঘাটের মাঝি। সিরাজরাও যোগ দেন সেই দলে। এরপর রূপসায় অনেক জল গড়িয়েছে। বইঠার নৌকায় ইঞ্জিন বসেছে। রূপসার ঘোলা জলে দাপিয়ে বেড়ানো সেদিনের কিশোরের চোখে-মুখে বয়সের ছাপ পড়েছে। তবে ভাগ্য পরিবর্তনের যে আশায় ভিন শহরে পাড়ি জমিয়েছিলেন, তা আর হয়নি। অভাব-অনটন আর বিষাদকে নিত্যদিনের সঙ্গী করে এখনো রূপসার বুকে রয়ে গেছেন সিরাজ আর সিরাজের মতো অনেকেই।

বুধবার সকালে রূপসা ঘাটের পশ্চিম পাড়ের পন্টুনে বসে কথা হয় সিরাজের সঙ্গে। সিরাজ বললেন, ‘অনেক ছোটবেলায় বাবা মারা গ্যাছে। দ্যাশে তখন খুবই অভাব। এলাকায় কোনো কাজ ছেল না। আমাগো এলাকার অনেকে তখন খুলনা থাকে। তাঁদের বুদ্ধি পরামর্শে খুলনা চলে আসি। অন্য পেশায় ভাগ্য অনেক বদলিছে। আমাগো মাঝিগো কোনো পরিবর্তন হলো না।’

সিরাজের মতো যাদের নিজস্ব ট্রলার নেই, কিন্তু মাঝির খাতায় নাম আছে, তাঁদের ‘বেকার মাঝি’ বলা হয়। ট্রলার যখন ডকে মেরামতে থাকে, তখন ওই ট্রলারের মালিকও ‘বেকার মাঝির’ কাতারে পড়েন।

‘বেকার মাঝির’ বিষয়টা সিরাজসহ ঘাটে বসে থাকা আরও আট-নয়জন মাঝি বুঝিয়ে বললেন। তাঁরা জানালেন, ঘাটে প্রায় এক শর ওপরে ট্রলার আছে। নিয়মানুযায়ী প্রতিদিন পালা করে অর্ধেক ট্রলার বসে থাকে, বাকি অর্ধেক চলে। বেকার মাঝিরা কোনো নির্দিষ্ট ট্রলারে কাজ করেন না। যাঁরা বেকার মাঝি, তাঁরা প্রথমে সিরিয়াল দেন। সিরিয়াল অনুযায়ী তাঁরা ট্রলারে উঠে পড়েন। কখনো ট্রলার চালান, কখনো আবার টাকা উঠানোসহ অন্য সহায়তা করেন। আর এই বাবদ প্রতিটি ট্রিপের জন্য তাঁরা ২০ টাকা করে পান। অন্য পাড়ে গিয়ে আবার সিরিয়াল দিতে হয়। আবার একই কাজ। তবে একজন বেকার মাঝি টানা দুই দিন কাজ করতে পারবেন না। এক দিন পর পর তাঁরা কাজ করতে পারেন।

রূপসা ঘাটে প্রতিদিন পালা করে অর্ধেক ট্রলার বসে থাকে, বাকি অর্ধেক চলাচল করে
ছবি: প্রথম আলো

সিরাজ বলেন, সমিতির পক্ষ থেকে এই ব্যবস্থা। তাঁরা এখানে ৪০ জনের মতো বেকার মাঝি আছেন। ফজরের আজানের পর থেকে রাত আটটা-নয়টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ ২০টার মতো ট্রিপ পাওয়া যায়। তাতে যেদিন যেদিন কাজ করতে পারেন, ৪০০ টাকার মতো আয় হয়। অন্য সহায়তা পান না। ভোট দেন, সব করেন। কিন্তু তাঁরা তো ভাসা। চেয়ারম্যান-মেম্বাররা স্থানীয় লোকজনকে এত কিছু দেন, তাঁদের কপালে ছাইও জোটে না।

জীবনের বেলাভূমে দাঁড়িয়েও সংসার চালানো নিয়ে ভীষণ চিন্তিত সিরাজ বলেন, ‘মাসে সর্বোচ্চ আয় ধরলে ছয় হাজার টাকার মতো। ঘরভাড়া দিয়ে খেয়েপরে চলতে পারছি না। ৬০ টাকা কেজি চাল-আটা কিনছি। বনরুটির দাম এখন ১০ টাকা। কয়েক দিন আগের ১০০ টাকার পাঙাশ মাছ ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি। মাছ কিনব; না ভাত খাব। আবার এক দিন বাদে এক দিন কামাই। যেদিন কাজ থাকে তিন বেলা খাইতে পারি। পর দিনের অবস্থা কাহিল হইয়ে যায়।’

সিরাজের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন কালু হাওলাদারসহ আরও ৮-১০ জন। সিরাজের কথা শেষ না হতেই কালু বললেন, ‘সংসারে আমরা আটজন। বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, পাঁচ দিন ধরে ডালের মধ্যে কিছু আলু কুঁচিয়ে দিয়ে খাচ্ছি। একই খাবার প্রতিদিন।’
চর রূপসায় বাবা-মা, স্ত্রী আর চার সন্তানকে নিয়ে থাকেন কালু (৪১)। বাসাভাড়া আড়াই হাজার টাকা। রূপসা ঘাটে তাঁর বাবা, দাদা সবাই মাঝিগিরি করতেন। কালু এই পেশায় প্রায় ৩০ বছর ধরে।

বংশ পরম্পরার পেশায় তৃতীয় প্রজম্মের প্রতিনিধি কালু হাওলাদার জানান, এক দিন পরপর চার শ টাকার মতো তাঁর আয়। আড়াই কেজি চাল কিনতে লাগে দেড় শ টাকা। প্রতিদিন দেনা হয়। সেগুলো শোধ দেওয়া লাগে। ঘরভাড়ার জন্য কম করে এক শ টাকা রাখা লাগে। বাচ্চারা স্কুলে যায়, তাদের হাতে এক-দুই টাকা দেওয়া লাগে। বয়স্ক মা-বাবার জন্য ওষুধও কিনতে হয়।

বংশ পরম্পরার মাঝির কাজে জড়িত কালু হাওলাদার
ছবি: প্রথম আলো

কালু বলেন, ‘হালত খুব খারাপ ভাই। দুঃখের কথা কাউরে কওয়া যায় না। আমার সঙ্গে গিয়ে দেখেন খারাপ খাইতে খাইতে আমার পোলাপান পুষ্টিহীন হয়ে গেছে। আমার অবস্থাও তাই। একটু যে পুষ্টিকর খাবার খেয়ে শরীরে বল শক্তি হবে, দৌড়ে কাজ করব, সে ক্ষমতাও নেই।

পুষ্টিকর খাবারের বিষয়টা পরিষ্কার করতে কালু আবার বলেন, ‘মাছ খাই না হাতে গোনা ১১ দিন। কম টাকায় সাগরের মাছ কিনতাম, এখন সাগরে মাছ ধরা বন্ধ হওয়ায় মাছও আসছে না। আর দেশি মাছ কেনার কথা তো আমরা চিন্তাও করি না। এক কোরবানি ছাড়া গরুর মাংস চোহে দেখি না। মনডা চায়। মাংস না কিনতি পারি একটু ছাঁট মাংস কিনি। তাও অনেক দাম। আর শোনেন দোকানে গেলে বিশ টাকার এতটুকু তেল দেয়। ওইটা দিয়া সেদ্ধর মতো কোনোমতে চলে। বাড়িওয়ালা (স্ত্রী) দোকানে যায়। আমরা পুরুষ মানুষ ২০ টাকার তেল চাইতে লজ্জা তো করে।’

বিষণ্ন মুখে কালু বলেন, ‘হেব্বি কষ্ট হচ্ছে। আমাগো সংসারে যে নারীরা আছে আল্লাহ এগোরে মনডা নরম কইরে দেছে বলে থাহে। অন্য নারীরা হলে থাকত না। কোনো সময় ভালো একটা জিনিসও খাইতে দিতে পারি না। পইড়ে গিয়ে কোমরে ব্যথা লাগাইছে। একটু ওষুধ কিনে যে খাওয়াব পারতিছি নে। দুইডা করে ব্যাথার বড়ি কিনতেছি। একটু যে ডাক্তার দেখাব তা তো উপায় নেই। এত কষ্টের চাইতে তাড়াতাড়ি কবরে যাওয়াডা ভালো। আর পারা যাচ্ছে না।’

ঘাটে থাকা অন্য মাঝিরাও বেশ খানিকটা সময় ধরে তাঁদের দুর্দশার কথা অনর্গল বলে গেলেন। মাঝি সোহাগ শিকদার বললেন, ‘এত কথার শেষ কথা হচ্ছে, আমরা মাঝিরা এখন খুবই কষ্টে দিন কাটাচ্ছি।’