সুনামগঞ্জকে বলা হয় ‘হাওরকন্যা’। হাওর ঘিরে জেলার এই পরিচিতির মূলে টাঙ্গুয়ার হাওর। এটি দেশের অন্যতম সুন্দর ও জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ সম্ভাবনাময় একটি জলাভূমি। টাঙ্গুয়ার হাওর আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় ‘রামসার সাইট’। প্রথমটি সুন্দরবন। সম্পদ, সম্ভাবনা আর অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি টাঙ্গুয়ার হাওর ১৭ বছর ধরে সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। হাওরের সম্পদ রক্ষা ও সংরক্ষণে কাজ করছে জেলা প্রশাসন। পাশাপাশি রয়েছে বেসরকারি উদ্যোগও। গাছ, মাছ, পাখি আর প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের আধার এই হাওর। রূপে-গুণে অনন্য টাঙ্গুয়ার হাওর এখন পর্যটকদের কাছে অতিপ্রিয়।
সুনামগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে তাহিরপর ও ধরমপাশা উপজেলায় এই হাওরের অবস্থান। ২টি উপজেলার ৪ ইউনিয়নের ১৮টি মৌজা মিলে হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৬৫৫ হেক্টর। হাওরে ছোট বড় ১০৯টি বিল আছে। তবে প্রধান বিল ৫৪টি। হাওরের ভেতরে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য খাল ও নালা। বর্ষায় সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তখন হাওর রূপ নেয় সমুদ্রে। হাওর এলাকার ৮৮টি গ্রামের প্রায় ৬০ হাজার মানুষ হাওরের ওপর নির্ভরশীল। হাওরের উত্তরে ভারতের মেঘালয় পাহাড়। এই পাহাড় থেকে ৩৮টি ঝরনা নেমে এসে মিশেছে টাঙ্গুয়ার হাওরে।
টাঙ্গুয়ার হাওরকে বলা হয় দেশি মাছের আধার বা ‘মাদার ফিশারিজ’। জলজ প্রাকৃতিক বন, পরিযায়ী ও দেশি পাখির নিরাপদ আবাসস্থল। এটি দেশি মাছের অন্যতম প্রজননক্ষেত্র। প্রতিবছর শীত মৌসুমে দেশি ও পরিযায়ী লাখো পাখির মেলা বসে এখানে। দীর্ঘদিন পানির নিচেও টিকে থাকতে পারে এমন কিছু বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ এখানে আছে। বিলুপ্তপ্রায় হিজল, করচগাছের পাশাপাশি এখানে রয়েছে নলখাগড়া, সিঙরা, চাইল্যা, বইল্যা, বনতুলসী, উকল, গুইজ্জাকাঁটা, শালুক ও শাপলা।
হাওরে ১৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৪১ প্রজাতির মাছ, ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি ও ২১ প্রজাতির সাপ দেখা যায়। অস্তিত্বের হুমকিতে থাকা ২৬ প্রজাতির বন্য প্রাণীর আবাসভূমিও এই হাওর। এখানে দেখা মেলে বিরল প্রজাতির প্যালাসার ফিশ ইগলের। সর্বশেষ গণনা অনুযায়ী (২০১৬ সাল) এই হাওরে ৯১ হাজার ২৩৬টি পরিযায়ী পাখি এসেছে। হাওরে মাছের মজুত আছে ৬ হাজার ৭০১ মেট্রিক টন। এখানে বিলুপ্তপ্রায় মাছের মধ্যে আছে চিতল, মহাশোল, নানিদ, সরপুঁটি, বাগাড় ও রিটা। বেশি পাওয়া যায় রুই, গইন্যা, কাতলা, কালবাউশ, শোল, গজার, টাকি, মেনি, বোয়াল ট্যাংরা ইত্যাদি।
বর্ষা ও শুকনা মৌসুমে টাঙ্গুয়ার হাওরের দুই রূপ চোখে পড়ে। বর্ষায় দিগন্তবিস্মৃত জলরাশি। এই জলরাশির ওপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে হিজল ও করচগাছের বাগান। তখন হাওরের গ্রামগুলোকে মনে হয় ছোট ছোট দ্বীপ। যেন জলের ওপর ভাসছে। হাওরের জলে ঢেউয়ের খেলা তখন পর্যটকদের মন ভরিয়ে দেয়। তবে দুই মৌসুমের সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো। হাওরের উত্তরে সবুজে মোড়া মেঘালয় পাহাড়। পাহাড়ের পাদদেশে হাওরপারে স্বাধীনতা উপত্যকা, শহীদ সিরাজ লেক, নিলাদ্রী ডিসি পার্ক। দেখা যায়, আকাশে শুভ্র মেঘের ওড়াউড়ি। বিকেলের রোদে মেঘের ছায়া পড়ে নীল হয়ে ওঠে হাওরের জল। তখন পুরো এলাকাকে ছবির মতো মনে হয়। শুকনা মৌসুমে হাওরে জল থাকে কম। তখন পায়ে হেঁটেই হিজল ও করচবাগানের ভেতর দিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায়। পুরো হাওরকে চোখের সীমানায় নিয়ে আসতে রয়েছে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার।
টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরে বেড়াতে এখন বেশ ভালো সুযোগ-সুবিধা রয়েছে পর্যটকদের জন্য। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে পর্যটকদের জন্য ভাড়ায় মিলে বেশ কিছু ছোট–বড় নৌকা। এসব নৌকায় রয়েছে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা। তবে এসব নৌকা ভাড়া নিতে আগে যোগাযোগ করা ভালো। পাশাপাশি স্পিডবোটও রয়েছে। স্পিডবোটের ভাড়া বেশি। যাঁরা কম সময়ে হাওর ঘুরে দেখতে চান, তাঁদের জন্য স্পিডবোট ভালো। জোছনা রাতে নৌকায় নেচে–গেয়ে আনন্দ করেন পর্যটকেরা। সুনামগঞ্জ এসে টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরে না গেলে আপনার ভ্রমণটাই অপূর্ণ থেকে যাবে।