রোগীদের কাছে আশীর্বাদ চিকিৎসক কামরুল আজাদ

কামরুল আজাদ
ছবি: সংগৃহীত

বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত করোনা পজিটিভ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন ৩২৩ জন। তাঁদের মধ্যে ৩১৭ জনই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এসব রোগীর সেবা-শুশ্রূষায় প্রধান ভূমিকা রেখেছেন করোনা ওয়ার্ডের চিকিৎসক কামরুল আজাদ।

সুস্থ হওয়া রোগীদের অন্তত ১১ জনের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁরা বলেন, করোনার সময়ে তিনি (কামরুল আজাদ) ছিলেন আশীর্বাদের মতো। তাঁর আন্তরিকতা, সেবা, রোগীদের মানসিক শক্তি জোগানোর ঐকান্তিক চেষ্টা—এসব বিষয় সবাইকে মুগ্ধ করেছে।

৪১ বছর বয়সী কামরুল আজাদ বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের একমাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। ৫০ শয্যার করোনা ওয়ার্ডের দায়িত্বও তাঁর কাঁধে। মেডিসিন ওয়ার্ডের নিয়মিত রোগীর চিকিৎসাসহ জেলার অন্য হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণও দিয়েছেন তিনি। কামরুল আজাদের নেতৃত্বে ১০ জনের দল পুরো বিভাগে আশার আলো ছড়াচ্ছে।

একজন এফসিপিএস চিকিৎসক হয়েও কামরুল আজাদ যেভাবে একটানা কাজ করছেন, সেটা সারা দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের জন্য অনুকরণীয়। তাঁকে নিয়ে আমরা গর্বিত।
সোহরাফ হোসেন, বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক

কামরুল আজাদ কেন এত প্রশংসা পেলেন? জানতে হলে একটু পেছনে যেতে হবে। বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে করোনা ইউনিট স্থাপনের মতো কোনো অবকাঠামো ছিল না। এরই মধ্যে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে চীনফেরত এক ছাত্র করোনার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসেন। তখনো করোনার চিকিৎসায় চিকিৎসকেরা প্রশিক্ষণ পাননি। তবে সাহস নিয়ে এগিয়ে আসেন চিকিৎসক কামরুল। হাসপাতালের সীমিত অবকাঠামোর মধ্যে ওই ছাত্রকে আইসোলেশনে রাখার ব্যবস্থা করেন। ইন্টারনেট ঘেঁটে তিনি ওই ছাত্রকে সেবা দেন। ঢাকা থেকে নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট নেগেটিভ এলে চিকিৎসক কামরুল ঝুঁকি বিবেচনায় তাঁকে ১৪ দিন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে পরিচর্যা করেন। এভাবেই বরিশাল বিভাগে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে প্রথম আইসোলেশন ওয়ার্ড ও করোনা সন্দেহজনক রোগীর ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের সূচনা করেন তিনি।

মার্চের মাঝামাঝি হাসপাতালের ২৫০ শয্যার নির্মাণাধীন নতুন ভবনে করোনা ইউনিট খোলা হয়। ১৯ মার্চ ঢাকায় এক দিনের করোনা প্রশিক্ষণের জন্য যান কামরুল আজাদ। ঢাকাতেই তাঁর সাত বছর বয়সী একমাত্র ছেলে, স্ত্রী, ক্যানসারে আক্রান্ত শাশুড়ি, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মা-বাবা থাকেন। ঢাকা থেকে প্রায় সাড়ে ৪০০ কিলোমিটার দূরের কর্মস্থল থেকে সব দেখভাল করতে হয় তাঁকে।

প্রশিক্ষণ শেষে ২৫ মার্চ সকালে বরগুনায় ফেরেন কামরুল আজাদ। করোনার উপসর্গ নিয়ে অনেক রোগী হাসপাতালে। তাঁদের সবার চোখে-মুখে আতঙ্ক। তিনি কাজে লেগে গেলেন। ২৫ মার্চ থেকে ১০ মে পর্যন্ত টানা দেড় মাস চিকিৎসাসেবা দেন। তিন দিনের কোয়ারেন্টিন শেষে আবার ফিরে আসেন কর্মস্থলে। একটানা চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। এরপর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে যাননি।

বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন কামরুল আজাদ ও তাঁর দল
ফাইল ছবি

করোনার চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে কামরুল আজাদের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ রয়েছে। তিনি বলেন, করোনায় মারাত্মক অবস্থায় পতিত হয় মাত্র ৫ ভাগ রোগী। তাই প্রথমেই রোগীদের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ রোগী নির্ণয় করতে হয়। অক্সিজেন ও প্রোনিং (উপুড় করে শুইয়ে রাখা) করা গেলে রোগীকে ঝুঁকিমুক্ত করা খুব সহজ। এ ছাড়া পুষ্টিজনিত ঘাটতি পূরণ, উপসর্গ অনুযায়ী তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়া এবং মানসিক দৃঢ়তা বাড়ানো খুব জরুরি।

বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সোহরাফ হোসেন বলেন, ‘একজন এফসিপিএস চিকিৎসক হয়েও কামরুল আজাদ যেভাবে একটানা কাজ করছেন, সেটা সারা দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের জন্য অনুকরণীয়। তাঁকে নিয়ে আমরা গর্বিত।’