রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যার কারণ সম্পর্কে যা বলছে অভিযোগপত্র

নিহত রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ
ছবি: সংগৃহীত

মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার ওরফে জুনুনির নির্দেশে ৩৬ সদস্য পরিকল্পিতভাবে গুলি করে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে (৫০) হত্যা করেন। কেন ও কীভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে, গতকাল সোমবার কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পুলিশের দাখিল করা অভিযোগপত্রে সেসব উল্লেখ করা হয়েছে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, মুহিবুল্লাহকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়ার পক্ষে ছিলেন তিনি। রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন দেশে পাচার প্রতিরোধে সোচ্চার ছিলেন। এ ছাড়া তিনি রোহিঙ্গাদের খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের বিরোধিতা করতেন। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন, রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায় ও শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে এআরএসপিএইচ নামে সংগঠন তৈরি করেন মুহিবুল্লাহ। তিনি শিক্ষিত এবং ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হওয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি ও বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হতো। তিনি সাধারণ রোহিঙ্গাদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন। এসব কারণে আরসা (আল–ইয়াকিন নামেও পরিচিত) নেতাদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ বাড়তে থাকে। আরসার প্রধান জুনুনিসহ অন্যরা তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

ঘটনার দুই দিন আগে ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে ক্যাম্প-১-এর নতুন মার্কাজ ফারুক মাঝির ব্লকে মাস্টার আবদুর রহিম ওরফে রকিমের অফিসকক্ষে গোপন বৈঠক বসে। বৈঠকে মুহিবুল্লাহকে হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, এরই ধারাবাহিকতায় ২৯ সেপ্টেম্বর মাগরিবের নামাজের পর ফারুক মাঝির ব্লকে মার্কাজের মোড়ে সালামত উল্লাহর দোকানের সামনে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হাজিন হন। সেখান থেকে মাস্টার আবদুর রহিম, ছমির উদ্দিন ওরফে নুর কামাল, মোজাম্মেল হোসেন ওরফে লাল বদিয়ার নেতৃত্বে খাইরুল আমিন, ফয়েজ উল্লাহ, জাহিদ হোসেন ওরফে লুলু ও আজিজুল হক দেশীয় পিস্তল নিয়ে মুহিবুল্লাহর অফিসকক্ষে যান। আসামি শুক্কুর আলম ও মাস্টার শফি আলম পিস্তল নিয়ে মুহিবুল্লাহর অফিসের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। মুহিবুল্লাহ অফিসে ছিলেন না। তাঁকে ডেকে আনার সিদ্ধান্ত হয়।

আরও পড়ুন

২৯ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে আটটার দিকে এশার নামাজ শেষে মুহিবুল্লাহ তাঁর নিজের ঘরে ছিলেন। এ সময় মোরশেদ ওরফে মুর্শিদ বসতঘরে গিয়ে মুহিবুল্লাহকে ডেকে অফিসে নিয়ে আসেন। একটু পর আরসা নেতা মাস্টার আবদুর রহিম, আবদুস সালাম, মোজাম্মেল হোসেন ওরফে লাল বদিয়া, খাইরুল আমিন, জাহিদ হোসেন ওরফে লালুসহ অন্যরা তাঁর অফিসে যান।

আরসা নেতা মাস্টার আবদুর রহিম প্রথমে মুহিবুল্লাহর নাম ধরে বলেন, ‘আমরা তোকে নিয়ে যেতে এসেছি, তুই ওঠ।’ কথা শুনে মুহিবুল্লাহ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালে মাস্টার আবদুর রহিম নিজের হাতে থাকা পিস্তল দিয়ে মুহিবুল্লাহর বুকের ডান পাশে একটি গুলি করেন। এরপর জাহিদ হোসেন ওরফে লালু নিজের হাতে থাকা পিস্তল দিয়ে মুহিবুল্লাহর বুকের ডান পাশে এবং নাভির ওপর পরপর আরও দুটি গুলি করেন। চতুর্থ গুলিটি করেন খাইরুল আমিন নিজের হাতে থাকা পিস্তল দিয়ে। গুলিটি ডান কাঁধে বিদ্ধ হয়। গুরুতর জখম অবস্থায় মুহিবুল্লাহ মাটিতে লুটি পড়লে অস্ত্রধারীরা ফাঁকা গুলি চালিয়ে ক্যাম্পের ভেতরে আত্মগোপন করেন।

আরও পড়ুন

অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা প্রতিনিধি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন মুহিবুল্লাহ। এর কিছুদিন পর ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট ‘রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস’ পালনের লক্ষ্যে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে দুই লাখ রোহিঙ্গার সমাগম ঘটেছিল। মুহিবুল্লাহর ডাকে রোহিঙ্গারা সেখানে সমবেত হয়েছিল। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনবিরোধী সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার প্রধান নেতা জুনুনি কিছুতেই মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বকে মেনে নিতে পারছিলেন না এবং ভবিষ্যতে আরসার কর্মকাণ্ডের জন্য মুহিবুল্লাহ হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারেন—এ ভাবনা থেকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়।

গতকাল পুলিশ ২৯ জনের নামে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়। এর মধ্যে ১৫ জন বর্তমানে জেলা কারাগারে বন্দী। প্রথম গুলি চালানো রহিমসহ ১৪ জন ঘটনার পর থেকে পলাতক। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সবাই আরসার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী। তাঁরা সবাই রোহিঙ্গাশিবিরে চুরি, ডাকাতি, হত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, মানব পাচার, মাদক কারবারসহ বিভিন্ন অপরাধকর্মে জড়িত বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন উখিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গাজী সালাহ উদ্দিন।

পুলিশ জানায়, ২০২১ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার লাম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের ডি ব্লকের ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ (এআরএসপিএইচ) সংগঠনের কার্যালয়ে বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ। তিনি ওই সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন। পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন। ৮ মাস ১৩ দিন পর গতকাল আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।