রোহিঙ্গা শিবিরে আগুনে পুড়ে মরলেন ১১ জন, ১০ হাজার ঘর ছাই

আগুনে পুড়ে যাওয়া কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরের একাংশছবি: আইওএম’র সৌজন্যে

কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরে আগুনের ঘটনায় আজ মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত ১১ জনের লাশ উদ্ধারের কথা জানিয়েছে পুলিশ। এখানকার চারটি ক্যাম্পের ১০ হাজারের বেশি ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। গৃহহীন হয়ে অর্ধ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের পাশে, পাহাড়, জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। ঘটনা তদন্তে আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

ছয় শিশুসহ ১১ জনের মৃত্যুর খবরের সত্যতা প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. আজাদ মিয়া। তবে রোহিঙ্গা শিবিরে কর্মরত এনজিওদের সমন্বয়কারী সংস্থা ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি) দাবি করেছে, অগ্নিকাণ্ডে ১০ হাজার ঘর পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় অন্তত ১৫ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ৪৫০ জন। গৃহহীন হয়েছেন প্রায় ৪৫ হাজার। নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত ৪০০ রোহিঙ্গা। আর জাতিসংঘের শরণার্থী–বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রেস ব্রিফিংয়ে বলা হয়েছে, অগ্নিকাণ্ডে ১৫ জন মারা গেছেন।

নিহত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৯ জনের পরিচয় শনাক্ত করেছে পুলিশ। তাঁরা হলেন সলিম উল্লাহ (৫৫), রফিক আলম (২৫), আবদুল্লাহ (৮), আসমাউল (৭), মিজানুর রহমান (৪), বশির আহমদ (৬৫), খতিজা বেগম (৭০), মো. একরাম (৩), এমদাদ উল্লাহ (২৪)।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আমিন আল পারভেজ আজ বিকেল পাঁচটায় প্রথম আলোকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানের জন্য শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ রেজওয়ান হায়াতকে প্রধান করে আট সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, এপিবিএনের অধিনায়কসহ বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তাদের রাখা হয়েছে। আগামীকাল বুধবার থেকে তদন্ত শুরু হবে।

গৃহহীন রোহিঙ্গাদের অনেকে দাবি করেছেন, পরিকল্পিতভাবে ক্যাম্পে আগুন দিয়েছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। ক্যাম্পে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির পাশাপাশি মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্বিত এবং নোয়াখালীর ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে চান তাঁরা। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পার হলেও সেটি পরিকল্পিত কিনা, সে ব্যাপারে নিশ্চিত নয় প্রশাসন।

হতাশা নিয়ে আগুনে পোড়া ঘরের দিকে তাকিয়ে আছেন কেউ কেউ। আবার অনেকে খুঁটি পুঁতে ছাউনি তোলা শুরু করে দিয়েছেন

বেলা ১১টায় বালুখালীর পুড়ে যাওয়া ক্যাম্প পরিদর্শনে যান পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন। ঘটনাস্থলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরে আগুন লাগার নেপথ্য কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে নাকি স্বাভাবিক উপায়ে ক্যাম্পে আগুন ধরেছে, তা অনুসন্ধানের জন্য উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্তে আগুন লাগার পেছনে কারও হাত কিংবা সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে রেহাই দেওয়া হবে না।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, গতকাল বেলা তিনটার দিকে বালুখালী ৮ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরের একটি ঘর থেকে আগুনের সূত্রপাত। একপর্যায়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে শিবির লাগোয়া ৮-ডব্লিউ ও এইচ, ৯ ও ১১ নম্বর শিবিরেও। রাত পৌনে ১০টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।

পোড়া ভিটায় ছাউনি তুলে কোলের শিশুটিকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন এক অভিভাবক
প্রথম আলো

আগুনের সূত্রপাত ও কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৬ এপিবিএনের অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এখন আশ্রয়হীন রোহিঙ্গাদের মানবিক সেবা দেওয়া হচ্ছে। নিখোঁজ রোহিঙ্গা নারী-শিশুদের উদ্ধারে তৎপরতা চালানো হচ্ছে।

আগুনের সূত্রপাত গ্যাস সিলিন্ডার থেকে হতে পারে জানিয়ে উখিয়া ফায়ার সার্ভিসের দলনেতা ইমদাদুল হক বলেন, রোহিঙ্গা বসতির ঘরগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা লাগানো। একটিতে আগুন ধরলে অন্যটি রক্ষা করা কঠিন। তা ছাড়া বসতিগুলো নির্মাণ হয়েছে একাধিক পাহাড়ের ঢালুতে। সেখানে হেঁটে হেঁটে আসা-যাওয়া করেন রোহিঙ্গারা। যেখানে মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়া যায় না, সেখানে দমকল বাহিনীর গাড়ি পৌঁছানো অনেক কঠিন। এ কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে চারটি ইউনিটের কয়েক ঘণ্টা সময় লেগে গেছে। গতকাল রাত পৌনে ১০টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হলেও কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে আগুন জ্বলতে থাকে।

হতাশ দৃষ্টিতে পুড়ে যাওয়া ঘর দেখছেন এক তরুণ
প্রথম আলো

উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে সরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি শুকনা খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে গৃহহীন রোহিঙ্গাদের জন্য রান্না করা খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশ পালিয়ে আশ্রয় নেন আট লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে আসেন আরও কয়েক লাখ। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ। এর মধ্যে উখিয়ার ২৩টি আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা আছে প্রায় ৯ লাখ।

সব পুড়ে গেছে। অক্ষত আছে গ্যাসের সিলিন্ডারগুলো
প্রথম আলো