লকডাউন তুলে দিয়ে নওগাঁয় বিশেষ বিধিনিষেধ আরোপ

প্রেস ব্রিফিংয়ে নওগাঁর জেলা প্রশাসক হারুন-অর-রশীদ। আজ বুধবার দুপুরে নওগাঁ সার্কিট হাউস মিলনায়তনে।
ছবি: প্রথম আলো

নওগাঁয় সাত দিনের আংশিক লকডাউন শেষে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি রোধে আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে ১৬ জুন পর্যন্ত পুরো জেলায় বিশেষ বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। আজ বুধবার দুপুরে নওগাঁ সার্কিট হাউস মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জেলা প্রশাসক হারুন-অর-রশীদ এ ঘোষণা দেন।
সম্প্রতি উদ্বেগজনক হারে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ৩ জুন থেকে নওগাঁ পৌরসভা ও নিয়ামতপুর উপজেলায় সাত দিনের সর্বাত্মক লকডাউন এবং সাপাহার, পোরশা ও মান্দা উপজেলার হাটবাজার এলাকায় বিধিনিষেধ আরোপের ঘোষণা করেছিল স্থানীয় প্রশাসন।

আজ জেলায় সাত দিনের আংশিক লকডাউন ও বিধিনিষেধের শেষ দিনে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জেলা প্রশাসক হারুন-অর-রশীদ বলেন, ‘সাত দিনের আংশিক লকডাউন ও বিধিনিষেধ আরোপের কিছুটা সুফল আমরা পেয়েছি। আজ থেকে সাত দিন আগে করোনা সংক্রমণের হার যেখানে ২৫ শতাংশের ওপরে ছিল, সেটা এখন ৮ শতাংশের কাছাকাছি নেমেছে। গতকাল মঙ্গলবার জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির মিটিংয়ে সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সংক্রমণ স্থিতিশীল হওয়ায় আগামীকাল থেকে ১৬ জুন পর্যন্ত পুরো জেলায় ১৫ দফার বিশেষ বিধিনিষেধ আরোপের সিদ্ধান্ত হয়।’

১৫ দফা বিধিনিষেধে বলা হয়, জেলায় সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকানপাট খোলা রাখা যাবে। হোটেল–রেস্তোরাঁ শুধু পার্সেল আকারে বা অনলাইনে অর্ডার গ্রহণ করে খাবার বিক্রয় করতে পারবে। রাস্তার পাশে চায়ের দোকান খোলা রাখা যাবে না। ওষুধ, খাদ্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়, চিকিৎসাসেবার মতো প্রয়োজন ছাড়া সন্ধ্যা সাতটা থেকে পরের দিন সকাল আটটা পর্যন্ত কোনো অবস্থাতেই বাড়ির বাইরে যাওয়া যাবে না।

‘নওগাঁয় দ্বৈবচয়ন ভিত্তিতে চলতি পথের উপসর্গহীন করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা করে উদ্বেগজনক চিত্র পাওয়া গেছে।’
এ বি এম আবু হানিফ, সিভিল সার্জন, নওগাঁ

ঘোষণা অনুযায়ী, নওগাঁ জেলার সঙ্গে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার যাতায়াতের সব পথ বন্ধ থাকবে। জেলার অভ্যন্তরে নিয়ামতপুর উপজেলা বাদে অন্যান্য উপজেলায় বাস ও মাইক্রোবাস আসনসংখ্যার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে যাতায়াত করতে পারবে। সিএনজি ও অটোরিকশা শুধু দুজন যাত্রী নিয়ে চলাচল করতে পারবে।
আমের বাজার, কাঁচাবাজার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ক্রয়–বিক্রয় করা যাবে। শতভাগ মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে আইন আমান্যকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে জুমার নামাজসহ প্রতি ওয়াক্তে সর্বোচ্চ ২০ মুসল্লি অংশ নিতে পারবেন। অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়েও সমানসংখ্যক ব্যক্তি উপাসনা করতে পারবেন।

ব্রিফিংয়ে পুলিশ সুপার আবদুল মান্নান মিয়া, সিভিল সার্জন এ বি এম আবু হানিফ, নওগাঁ স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক উত্তম কুমার রায়, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ইব্রাহীম হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিভিল সার্জন এ বি এম আবু হানিফ বলেন, জেলায় র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট ও আরটি–পিসিআর পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে করোনা রোগী শনাক্ত করা হচ্ছে। আগের তুলনায় গত সাত দিনে করোনা শনাক্তের হার কিছুটা নিম্নমুখী। তবে এখনো উদ্বেগ রয়েছে। কারণ, গত রোববার থেকে গতকাল পর্যন্ত তিন দিনে নওগাঁয় দ্বৈবচয়ন ভিত্তিতে চলতি পথের উপসর্গহীন মানুষের করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা করে উদ্বেগজনক চিত্র পাওয়া গেছে। জেলার ১১টি উপজেলায় ভ্রাম্যমাণ ক্যাম্প করে ১ হাজার ৮০৬ জন চলতি পথের মানুষের র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট করা হয়। এতে ১৬৫ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। শনাক্ত হওয়া এই ব্যক্তিদের অধিকাংশই উপসর্গহীন ছিলেন। প্রায় ৩০ লাখ মানুষের এ জেলায় শনাক্তের বাইরে থেকে যাওয়া আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা পেতে স্বাস্থ্য বিভাগ গত রোববার থেকে গতকাল পর্যন্ত সদরসহ ১১ উপজেলায় একযোগে এই অ্যান্টিজেন পরীক্ষা চালানো হয়।
এ বি এম আবু হানিফ আরও বলেন, ‘পরীক্ষার যে ফলাফল পাওয়া গেছে, তাতে আমাদের কাছে উদ্বেগজনক মনে হয়েছে। ফলাফল দেখে মনে হয়, জেলায় উপসর্গহীন আছে, এমন আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৩ বা ৪ শতাংশের কাছাকাছি। যাঁদের অধিকাংশই এখনো শনাক্তের বাইরে। তাই সংক্রমণ রোধ করতে পরীক্ষার সংখ্যা আরও বাড়ানোর জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি মানুষকে সচেতন হতে হবে। সবাই স্বাস্থ্যবিধি না মানলে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।’
সীমান্ত জেলা নওগাঁয় ভাইরাসের প্রকোপ বাড়ছিল ঈদের পর থেকেই। দৈনিক শনাক্ত রোগী বাড়তে থাকায় ৩ জুন থেকে নওগাঁ পৌরসভা ও নিয়ামতপুর উপজেলায় সর্বাত্মক লকডাউন ও সাপাহার, পোরশা ও মান্দা উপজেলায় হাটবাজার এলাকায় বিধিনিষেধ জারি করে জেলা প্রশাসন।

২৪ ঘণ্টায় আরও ৫২ জনের করোনা শনাক্ত

নওগাঁ জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ৩৬ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। ২৯২ জনের নমুনা পরীক্ষায় নতুন করে ৫২ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার ১৭ দশমিক ৮১ শতাংশ।

এর আগের ২৪ ঘণ্টায় ৪৭২ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৩৬ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। শনাক্তের হার ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। গত রোববার সকাল ৮টা থেকে সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ১৯২ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১১৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
নওগাঁয় প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় গত বছরের ২৩ এপ্রিল। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ১৭ হাজার ৬১১ জনের নমুনা পরীক্ষায় ২ হাজার ৫৯২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় সর্বোচ্চ ১ হাজার ১৩৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে, যা পুরো জেলার করোনা শনাক্তের প্রায় ৪৪ শতাংশ। জেলায় করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে এ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ২ হাজার ৯২ জন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৪৮ জন মারা গেছেন। মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৯১ শতাংশ।