লঞ্চঘাটগুলোতে নেই কোলাহল, বিপাকে লক্ষাধিক শ্রমিক

বরিশাল লঞ্চঘাটে সারি বেঁধে ঢাকা–বরিশালসহ বিভিন্ন রুটের লঞ্চ নোঙর করে রাখা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে তোলা ছবিছবি: প্রথম আলো

ঈদের আগে দিনরাত দক্ষিণাঞ্চলের ঘাটগুলোতে দম ফেলার সময় থাকত না লঞ্চের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। আর পন্টুনে পা ফেলার জায়গাও মিলত না। লঞ্চের হুইসেল ও মানুষের হইহুল্লোড়ে সরব থাকত দক্ষিণের ঘাটগুলো। কিন্তু এবার সেই কোলাহলমুখর ঘাটগুলোতে নেমে এসেছে নিস্তব্ধতা। পন্টুনে সারিবদ্ধভাবে নোঙর করে রাখা হয়েছে লঞ্চ।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার গত ৫ এপ্রিল থেকে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এরপর এক মাসের বেশি সময় ধরে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের নদীবন্দর ও লঞ্চঘাটগুলোতে সুনসান নীরবতা।

সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে দূরপাল্লা ও অভ্যন্তরীণ নৌপথে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে এসব নৌযানের লক্ষাধিক শ্রমিক-কর্মচারী মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন।

বৃহস্পতিবার দুপুরে বরিশাল নদীবন্দর ঘুরে দেখা যায়, বন্দরের সার বেঁধে নোঙর করে আছে অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লা মিলিয়ে অর্ধশত লঞ্চ। এসব লঞ্চ দেখাশোনার জন্য কিছু কর্মচারী শুয়ে-বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন। অলস সময় নিজেদের মধ্য গল্প করে কিংবা লুডু খেলে সময় পার করছেন।

লঞ্চশ্রমিকেরা জানান, তাঁদের বেতন খুব বেশি নয়, তবে লঞ্চ চললে কোম্পানি থেকে যেমন সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়, তেমনি বাড়তি আয়ের সুযোগ থাকে। তবে লঞ্চ চলাচল বন্ধের কারণে এসব সুযোগ বন্ধ রয়েছে। যাঁরা লঞ্চে আছেন তাঁদের অনেকে বেতন পেয়েছেন বোনাস পাননি, আবার অনেকে এখনো বেতন পাননি।

ঢাকা-বরিশাল নৌরুটের বিলাসবহুল এমভি মানামী লঞ্চের লস্কর মো. কাওসার বললেন, ‘লঞ্চ চলুক আর না চলুক কোম্পানির মালিকেরা কোটি কোটি টাকার সম্পদ আমাদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। তাই লকডাউনে ঘাটে বেঁধে রাখা লঞ্চের দেখাশোনা আমাদেরই করতে হয়। তাই ইচ্ছে থাকলেও বাড়িতে যেতে পারছি না।’

পারাবাত-১০ লঞ্চের সুকানি শাহাদাৎ হোসেন বলেন, প্রতিটি লঞ্চেই কিছু স্টাফ রয়েছেন, যাঁরা লঞ্চগুলো দেখাশোনা করছেন। লকডাউন চলায় যথাসময়ে বেতন পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে বাড়িতে সময়মতো টাকা পাঠাতে না পারায় বাড়িতে স্বজনেরা কোনোভাবে দিন পার করছেন।

লঞ্চশ্রমিকেরা জানান, তাঁদের বেতন খুব বেশি নয়, তবে লঞ্চ চললে কোম্পানি থেকে যেমন সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়, তেমনি বাড়তি আয়ের সুযোগ থাকে। তবে লঞ্চ চলাচল বন্ধের কারণে এসব সুযোগ বন্ধ রয়েছে। যাঁরা লঞ্চে আছেন তাঁদের অনেকে বেতন পেয়েছেন বোনাস পাননি, আবার অনেকে এখনো বেতন পাননি। আর যাঁরা বাড়িতে রয়েছেন, তাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। এ ছাড়া লঞ্চ চলাচল না করায় কলম্যান, ঘাটশ্রমিক, ভাসমান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও খারাপ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। কেউ কেউ তো মানুষের কাছ থেকে হাত পেতেও সাহায্য নিচ্ছেন, আবার কেউ ধারসহ বিভিন্ন কারণে দেনাগ্রস্ত হচ্ছেন।

লঞ্চ শ্রমিকনেতারা জানান, লঞ্চের মাস্টার থেকে লস্কর—লঞ্চ চালাতে সবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়। তবে লঞ্চের সব কর্মচারীর অভিযোগ, যেভাবে দিনরাত পরিশ্রম করেন, সেই তুলনায় তাঁদের বেতন-ভাতা একেবারেই কম। লঞ্চ কর্মচারীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, লঞ্চ যিনি চালান, তিনি মাস্টার। তাঁর বেতন মাসে কমবেশি ১৫ হাজার টাকা। লঞ্চের যিনি সুকানি, তিনি লঞ্চের মাস্টারকে সহযোগিতা করেন, তাঁর বেতন ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা। আর যিনি লঞ্চ ঘাটে বাঁধেন, লঞ্চ পরিষ্কার রাখেন, তাঁর পদ লস্কর। একজন লস্করের বেতন সর্বসাকল্যে ৭ হাজার টাকার মতো। লঞ্চের কর্মচারীদের বেতনের পাশাপাশি থাকা-খাওয়ার সুযোগ দেয় মালিকপক্ষ। কর্মচারীরা থাকার জন্য লঞ্চের একটি কেবিন পান। দুপুর ও রাতের খাওয়ার খরচও মালিকপক্ষ দেয়।

বরিশাল লঞ্চঘাটে সারি বেঁধে ঢাকা–বরিশালসহ বিভিন্ন রুটের লঞ্চ নোঙর করে রাখা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে তোলা ছবি
ছবি: প্রথম আলো

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে কম আয়ের বেতনে সংসার চালাতে প্রতিনিয়ত হিমশিম খান লঞ্চের কর্মচারীরা। বেশির ভাগ কর্মীর স্ত্রী-সন্তান বসবাস করে গ্রামে। লঞ্চে কাজ করে মাস শেষে বেতন পেলে তাঁর বড় অংশ গ্রামে স্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেন তাঁরা। এর ওপর এখন লঞ্চ চলাচল বন্ধ। ঠিকঠাক বেতন না পাওয়ায় জীবন চলছে খুব কষ্টে। তার ওপর বোনাসও মেলেনি এবার।

ঢাকা-বরিশাল পথে চলাচলকারী একটি লঞ্চের লস্কর বলেন, ‘অনেক কষ্টে কাটছে আমাদের সময়। লঞ্চ চললে দুই টাকা ইনকাম করতে পারতাম। লঞ্চ তো বইয়া (বসা) আছে। বেতন পাই মাত্র সাত হাজার টাকা। লকডাউনে কোনো জাগায় যাওনও (যাওয়া) যায় না। গতবারের লকডাউনে খুব খারাপ সময় গেছে। অনেক কষ্টে আলহাম (ছিলাম)। কামাই-রোজগার (কাজ) আলহে না। খাওন-পরনে কি যে কষ্ট গ্যাছে। এইবারও হেই একই অবস্থা।’

ভোলার ইলিশা-ঢাকা নৌপথে চলাচলকারী লঞ্চ দোয়েল পাখির মাস্টার হোসেন আলী বলেন, অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্য দিয়ে এবারের ঈদ কাটবে লঞ্চশ্রমিকদের। কাজ নেই, তেমনি কোনো সহায়তাও নেই।

নৌযান শ্রমিকনেতারা জানান, শ্রমিকদের জীবন-জীবিকার বিকল্প ব্যবস্থা না করে ঘোষিত ঢিলেঢালা লকডাউনে সবচেয়ে বেশি দুরবস্থার শিকার যাত্রীবাহী লঞ্চ ও গণপরিবহনের শ্রমিকেরা। অথচ সারা দেশে অন্যান্য পরিবহন চলছে। নৌপথের লাখো শ্রমিক-কর্মচারী এক মাসের বেশি সময় ধরে আয়-রোজগার বন্ধ থাকায় মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন।

নদীতে ফেরি, ট্রলার, স্পিডবোট চলছে, শুধু চলতে পারছে না লঞ্চ। ঈদ ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলে মানুষ ঠিকই বিভিন্ন পরিবহনে চেপে গাদাগাদি করে বাড়িতে আসছে। অথচ লঞ্চ বন্ধ। এ কারণে লঞ্চশ্রমিকসহ ঘাটশ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সবাই কষ্টে আছেন।
আবুল হাশেম, নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের বরিশাল বিভাগীয় সভাপতি

এ বিষয়ে নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের বরিশাল বিভাগীয় সভাপতি আবুল হাশেম বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ রুটে বাসসহ বিভিন্ন গণপরিবহন চলছে, ট্রাক-পিকআপ ভ্যানসহ মালবাহী যানবাহনে যাত্রী টানা হচ্ছে, দূরপাল্লার বাসও চলছে। নদীতে ফেরি, ট্রলার, স্পিডবোট চলছে, শুধু চলতে পারছে না লঞ্চ। ঈদ ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলে মানুষ ঠিকই বিভিন্ন পরিবহনে চেপে গাদাগাদি করে বাড়িতে আসছে। অথচ লঞ্চ বন্ধ। এ কারণে লঞ্চশ্রমিকসহ ঘাটশ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সবাই কষ্টে আছেন। তাঁরা কীভাবে দিন কাটাচ্ছেন সে খোঁজও কেউ রাখছেন না। আর মালিকপক্ষ থেকে যতটুকু সহায়তা দেওয়া হচ্ছে তা-ও অপ্রতুল। আমরা সরকারি প্রণোদনার জন্য ঢাকায় তালিকা পাঠিয়েছি। এখনো কোনো সাড়া মেলেনি।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থার জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান ও সুন্দরবন লঞ্চের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমরা নিজ তহবিল থেকে শ্রমিকদের ত্রাণ দিয়েছি। কোনো কোনো লঞ্চমালিক ৫০ ভাগ বেতন-ভাতা দিয়েছেন। আবার কোনো কোনো লঞ্চমালিকের ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করার কথা রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সব শ্রমিকের আইডি কার্ডসহ তালিকা ঢাকায় পাঠিয়েছি।’