লবণে ‘পুড়ছে’ ১২টি গ্রাম

খাওয়ার পানির চাহিদা মেটে বৃষ্টির পানি ধরে রেখে ও অন্য এলাকা থেকে পানি সংগ্রহ করে।

ঘেরে লবণপানি তুলে চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে। এতে ঘেরের পাশে মাটির রাস্তা যাচ্ছে ভেঙে
প্রথম আলো

খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ও লতা ইউনিয়নের অন্তত ১২টি গ্রাম লবণাক্ততার শিকার। বছরের পর বছর এসব এলাকায় নোনাপানি তুলে চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে। খাওয়ার পানির চাহিদা মেটে বৃষ্টির পানি ধরে রেখে ও অন্য এলাকা থেকে পানি সংগ্রহ করে। লবণসহিষ্ণু গাছ ছাড়া এলাকায় তেমন কোনো গাছ নেই। ঘাস বা লতাজাতীয় গাছ না থাকায় দেখা দিয়েছে গবাদিপশুর খাদ্যসংকট।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ কেটে অবৈধভাবে পাইপ ও জলকপাট (স্লুইসগেট) বসিয়ে নদী থেকে জমিতে তোলা হয় নোনাপানি। ওই পাইপের কারণে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্ষা মৌসুমে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সামান্য পানি বাড়লেই ভেঙে যায় বাঁধ। এ ছাড়া লবণাক্ততার প্রভাবে মাটির সড়কগুলোও সহজে ভেঙে যাচ্ছে।

লবণপানি তুলে চিংড়ি চাষ থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন ওই দুই ইউনিয়নের মানুষ। জোট বেঁধেছেন লবণপানির চিংড়িঘেরের বিরুদ্ধে। সভা, সমাবেশ, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন তাঁরা। গত ৮ জানুয়ারি বাঁধের ওই পোল্ডারের আলোকদ্বীপ বাজারে লবণপানির ঘের বন্ধ করতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন এলাকাবাসী। সেখানেও সবাই একমত হন জমিতে লবণপানি না তোলার ব্যাপারে।

গত বছর বিভিন্ন সময় দুই ইউনিয়ন পরিষদের মাসিক সমন্বয় বৈঠকেও ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চিংড়িঘের বন্ধ করতে মত দিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরাও।

এ বিষয়ে দেলুটি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রিপন কুমার মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ইউনিয়নের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ লবণপানির ঘের বন্ধ করতে ইউনিয়ন পরিষদের কাছে আবেদন করেছিল। তারই পরিপ্রেক্ষিতে পরিষদ থেকে রেজল্যুশন করে ঘের বন্ধ করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে আবেদন করা হয়েছে।

রিপন কুমার মণ্ডল আরও বলেন, বর্তমানে ২০ নম্বর পোল্ডারের চারপাশে ১৫০টির বেশি অবৈধ পাইপ ও জলকপাট তৈরি করা হয়েছে। গত বছর পাউবো থেকে সেগুলো শনাক্ত করে উচ্ছেদের জন্য সংশ্লিষ্টদের চিঠিও দেওয়া হয়েছে। এলাকায়

মাইকিং করে তা সরিয়ে নিতে নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঘেরমালিকেরা সরাননি। এখন আশঙ্কা হচ্ছে, প্রভাবশালী ঘেরমালিকেরা যেকোনো সময় রাতের আঁধারে নদীর বাঁধ কেটে ঘেরে লবণপানি তুলতে পারেন।

পাউবোর ২০ নম্বর পোল্ডারটি লতা ও দেলুটি ইউনিয়নের ১২টি গ্রাম নিয়ে গঠিত। ওই দুই ইউনিয়নের মাঝ বরাবর চলে গেছে নড়া নদী। নদীটি ওই পোল্ডারের দুই ইউনিয়নকে ভাগ করেছে। পোল্ডারে জমির পরিমাণ প্রায় ১৬ হাজার বিঘা, মানুষ বাস করে ১০ হাজারের মতো।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৮২ সালের দিক থেকে ওই এলাকায় চিংড়ি চাষ শুরু হয়। বর্তমানে সেখানে এক হাজার থেকে তিন হাজার বিঘা জমিতে চিংড়ি চাষ করেন, এমন ঘেরমালিক আছেন ১০ জন। আর ২০০ থেকে ৫০০ বিঘার মতো জমির ঘেরমালিক আছেন ৩০ জন। ওই পোল্ডারের প্রায় ৯০ শতাংশ জমির মালিক এলাকায় থাকেন না। তাই তাঁরা জমিগুলো চিংড়িচাষিদের কাছে ইজারা দিয়ে রেখেছেন। প্রতিবছর সেখান থেকে টাকা পান।

ভুক্তভোগীদের কয়েকজন বলেন, ওই এলাকায় বড় ঘেরে যাঁরা চিংড়ি চাষ করেন, তাঁদের বেশির ভাগই বিভিন্ন জেলা সদরের বড় বড় ধনী ব্যক্তি। রাতে ঘেরমালিকের লোকজন এলাকায় মহড়া দেন। ঘেরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গেলে হুমকি-ধমকি ও হেনস্তা করা হয়।

২০ নম্বর পোল্ডারের লতা ইউনিয়নের মধ্যে ২০০ বিঘার ঘের রয়েছে অজিয়ার রহমানের। এলাকাবাসীর অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, ঘের থেকে মানুষ পাচ্ছে। আবার সেখানে ধানও চাষ করছে। অল্প কিছু মানুষ, যাদের জমি নেই, তাঁরাই ঘেরের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। একসময়ে ঘের করতে গিয়ে জোরজুলুম চলেছে। তবে এখন সেটা নেই। ঘেরের মালিকেরা নিজেদের জমির পাশাপাশি হয়তো অল্প কিছু জমি ইজারা নেন।

২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলায় উপকূলীয় অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০১০ সালে উপকূলীয় পাঁচ জেলায় অপরিকল্পিতভাবে চিংড়ি চাষ বন্ধ করতে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেছিল বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। ওই পাঁচ জেলার মধ্যে খুলনাও ছিল।

জানতে চাইলে বেলার খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ২০১০ সালে রিট আবেদন করার পর ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কৃষিজমিতে অপরিকল্পিতভাবে চিংড়ি চাষ বন্ধ করতে চূড়ান্ত রায় দেন। ওই রায়ের পর খুলনার দাকোপ উপজেলার ৩২ নম্বর পোল্ডারে চিংড়ি চাষ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু অন্যান্য এলাকায় কৃষিজমিতে নোনাপানি তুলে ঠিকই চিংড়ি চাষ হচ্ছে। মূলত ওই আদেশ পালন করতে অনীহা দেখা গেছে স্থানীয় প্রশাসনের।

এ বিষয়ে পাইকগাছার ইউএনও মমতাজ বেগম বলেন, যেহেতু এলাকার মানুষ লবণপানির ঘের না করার ব্যাপারে জোটবদ্ধ হয়েছেন, তাই ঘেরমালিক ও এলাকাবাসীদের নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করা হয়েছে। কিন্তু কোনো পক্ষই ছাড় দিতে রাজি নয়। এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে সমস্যার সমাধান করা যায়, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।