লাকসামে বিএনপির দুই নেতার হদিস মেলেনি সাত বছরেও

কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সাবেক সাংসদ সাইফুল ইসলাম হিরু (বাঁয়ে) ও লাকসাম পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি হুমায়ূন কবীর পারভেজ (ডানে)
সংগৃহীত

কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সাবেক সাংসদ সাইফুল ইসলাম হিরু ও লাকসাম পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি হুমায়ূন কবীর পারভেজ গুমের সাত বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ ২৭ নভেম্বর। দীর্ঘ সময়ে ওই দুই নেতার কোনো হদিস মেলেনি। স্বজনেরা তাঁদের ফিরে আসার অপেক্ষায় দিন গুনছেন।

এ ঘটনায় দীর্ঘ সময় পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। বাদী ও স্বজনেরা ওই প্রতিবেদনকে একপেশে ও মনগড়া উল্লেখ করে আদালতে নারাজি দেন। পরে বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি মাসের ১০ তারিখ আদালত মামলার তদন্ত করার জন্য এবার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দিয়েছেন।

জানতে চাইলে মামলার আইনজীবী বদিউল আলম সুজন বলেন, সিআইডি সাড়ে ৫ বছরে অন্তত ৬৩ বার আদালত থেকে সময় নিয়ে একটি মনগড়া প্রতিবেদন দিয়েছে। ওই তদন্ত প্রতিবেদন অগ্রহণযোগ্য। বাদীর নারাজির পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এখন মামলা পিবিআইতে স্থানান্তর করেছেন।

এ ঘটনায় দীর্ঘ সময় পর সিআইডি আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। বাদী ও স্বজনেরা ওই প্রতিবেদনকে একপেশে ও মনগড়া উল্লেখ করে আদালতে নারাজি দেন। পরে বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত মামলার পুনরায় তদন্ত করার জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছেন।

পরিবার ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর রাত সোয়া ৯টা থেকে রাত ১১টার মধ্যে কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার হরিশ্চর সড়কে র‍্যাবের একদল সদস্য লাকসাম ফেয়ার হাসপাতালের একটি অ্যাম্বুলেন্স (ঢাকা মেট্রো-ছ-৭১-১২৬৫) আটক করেন। ওই অ্যাম্বুলেন্স থেকে র‍্যাব সদস্যরা লাকসাম উপজেলা বিএনপির তৎকালীন সভাপতি সাইফুল ইসলাম, পৌর বিএনপির তৎকালীন সভাপতি হুমায়ূন কবির ও পৌর বিএনপির তৎকালীন সহসাংগঠনিক সম্পাদক (বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতা) জসিম উদ্দিনকে তুলে নিয়ে যান। পরে র‍্যাব জসিম উদ্দিনকে কুমিল্লার পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড এলাকায় অন্য একটি মাইক্রোবাসে তুলে দেয়। এরপর জসিম উদ্দিন এবং একই রাতে লাকসামে বিএনপি নেতা সাইফুল ইসলামে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে গ্রেপ্তার হওয়া ১০ ব্যক্তিকে র‍্যাব লাকসাম থানায় হস্তান্তর করে। কিন্তু সাইফুল ইসলাম ও হুমায়ূন কবীরকে তারা থানায় হাজির করেনি। এরপর থেকে তাঁরা ‘নিখোঁজ’ রয়েছেন।

সিআইডি মনগড়া একটি প্রতিবেদন দেয়। আমরা সেটি মানি না। এ ছাড়া ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রয়েছেন। ওঁদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে সিআইডি প্রতিবেদন দেয়নি। এ জন্য নারাজি দিই। এখন পিবিআইতে মামলা গেছে।
গোলাম ফারুক, হুমায়ূন কবীর পারভেজের ছোট ভাই ও মামলার বাদী

এ ঘটনায় ২০১৪ সালের ১৮ মে হুমায়ূন কবীর পারভেজের বাবা রংগু মিয়া কুমিল্লার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে একটি মামলা করেন। মামলায় র‍্যাব-১১-এর চাকরিচ্যুত প্রধান কর্মকর্তা (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, র‍্যাব-১১ কুমিল্লার কোম্পানি অধিনায়ক মেজর সাহেদ রাজী, ডিএডি শাহজাহান আলী, উপপরিদর্শক (এসআই) কাজী সুলতান আহমেদ ও অসিত কুমার রায়কে আসামি করা হয়। ওই বছরের ৩১ আগস্ট মামলার বাদী রংগু মিয়া মারা যান। পরবর্তী সময়ে ২০১৪ সালের ১৫ অক্টোবর মামলার বাদী পরিবর্তন করা হয়। তখন হুমায়ূন কবীর পারভেজের ছোট ভাই ও রংগু মিয়ার ছোট ছেলে গোলাম ফারুককে এ মামলার বাদী করা হয়। ২০১৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়। এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জালাল উদ্দিন আহম্মদ চলতি বছরের ২৭ আগস্ট মামলার তদন্ত প্রতিবেদন কুমিল্লার ৬ নম্বর আমলি আদালতে দাখিল করেন।

সাত বছরেও ওদের সন্ধান মেলেনি। ওদের অপেক্ষায় দিন গুনছি।
ফরিদা ইসলাম হাসি, সাইফুল ইসলাম হিরুর স্ত্রী

পাঁচ পৃষ্ঠার ওই তদন্ত প্রতিবেদনের শেষাংশে উল্লেখ করা হয়, ‘পারভেজ ও হিরু নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য বা স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে সিআর মামলায় বর্ণিত বিবাদীগণ কর্তৃক কথিত অপহরণপূর্বক গুমের ঘটনা হিসেবে সৃজন করা হইয়াছে মর্মে প্রতীয়মান হয়। ভবিষ্যতে সিআর মামলার ঘটনার বিষয়ে কোনো ক্লু উদ্‌ঘাটিত হলে অথবা কথিত ভিকটিমদ্বয় উদ্ধার হইলে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।’

এরপর ১০ নভেম্বর কুমিল্লার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শারমিন রিমার আদালতে ওই তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দেন মামলার বাদী গোলাম ফারুক। আদালতের বিচারক এরপর এই মামলার তদন্ত দেন পিবিআইকে।

হুমায়ূন কবীর পারভেজের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই মামলার কোনো কিনারা হলো না।’ সাইফুল ইসলাম হিরুর স্ত্রী ফরিদা ইসলাম হাসি বলেন, ‘সাত বছরেও ওদের সন্ধান মেলেনি। ওদের অপেক্ষায় দিন গুনছি।’

মামলার বাদী গোলাম ফারুক বলেন, ‘সিআইডি মনগড়া একটি প্রতিবেদন দেয়। আমরা সেটি মানি না। এ ছাড়া ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রয়েছেন। ওঁদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে সিআইডি প্রতিবেদন দেয়নি। এ জন্য নারাজি দিই। এখন পিবিআইতে মামলা গেছে।’