লাম্পি স্কিনে আক্রান্ত দেশের কয়েক লাখ গরু-মহিষ

মানুষের পর এবার দেশের গরু-মহিষ মশাবাহিত নতুন এক রোগের আক্রমণের মুখে পড়েছে। ৬২টি জেলার ৫ লাখ ৬২ হাজার গরু-মহিষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে মারা গেছে ১১১টি গরু। প্রতিদিনই দেশের নতুন নতুন এলাকায় এই রোগে আক্রান্ত গবাদিপশুর সংখ্যা বাড়ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে সারা দেশে লাম্পি স্কিন রোগটি সম্পর্কে খামারি ও কৃষকদের সচেতন করতে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। এর জন্য এক কোটি টিকা আমদানিরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তবে প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন পর্যন্ত যতটুকু প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাতে এই রোগ গরু-মহিষ থেকে মানুষের শরীরে ছড়ায় না। গরু ও মহিষের পাশাপাশি ছাগল ও ভেড়ার শরীরে রোগটি ছড়াচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করা উচিত। জরুরিভিত্তিতে রোগটি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ না নিলে মহামারি আকার ধারণ করতে পারে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) থেকে এরই মধ্যে লাম্পি স্কিন রোগটি সম্পর্কে বিশ্বজুড়ে সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, এরই মধ্যে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ ও পূর্ব ইউরোপ, চীন ও ভারতে এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে রোগটি ভারত ও চীন থেকে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে সংস্থাটি আশঙ্কা করছে।

জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূলত ভারত ও মিয়ানমার থেকে রোগটি বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। রোগটি এখনো আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে। আমরা পর্যায়ক্রমে সব গরুকে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।’ এই রোগ নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে খামারিদের সাবধান হওয়ার পরামর্শ দিলেন প্রতিমন্ত্রী।

রোগের লক্ষণ

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, লাম্পি স্কিন ভাইরাসজনিত চর্মরোগ। এই রোগে আক্রান্ত গরুর চামড়া কুঁচকে যায় ও গুটি হয়। অনেকটা পক্স রোগের মতো। এই রোগে আক্রান্ত গবাদিপশুর দুধ কমে যায়, দুর্বল হয়ে পড়ে, ওজন কমে আসে ও চামড়ার গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। রোগটি শীতকালে বাড়ে এবং দুই–তিন মাস পর্যন্ত থাকে। আক্রান্ত ১০ থেকে ২০ শতাংশ গরু মারা যেতে পারে বলে জানিয়েছেন এফএওর প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞরা। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে মাঠপর্যায়ে পাঠানো নির্দেশনায় খামারিদের উদ্দেশে বলা হয়েছে, এই রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর অথবা ভেটেরিনারি সার্জনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

বেশি আক্রান্ত চট্টগ্রামে

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে বর্তমানে ২ কোটি ৫৩ লাখ ২৮ হাজার গরু-মহিষ আছে। এসব গবাদিপশুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে চট্টগ্রামে। সেখানকার ৩১ লাখ ৪৫ হাজার গরুর মধ্যে ২ লাখ ৬০ হাজার এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এরপরেই রয়েছে খুলনা। সেখানকার ৩৬ লাখ গরুর মধ্যে ২৩ হাজার ৫৬৩টি আক্রান্ত হয়েছে। বরিশালে ২২ হাজার ২৩২টি, ঢাকায় ১৭ হাজার ৩০০, রাজশাহীতে ১৩ হাজার ৩৫৬, রংপুরে ৪ হাজার ২৫৬ ও সিলেটে ১৮২টি গরু লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত হয়েছে।

>

লাম্পি স্কিন গরুর ভাইরাসজনিত একটি চর্মরোগ, যা মশা-মাছির মাধ্যমে ছড়ায়। গরুর জন্য এক কোটি টিকা আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, আক্রান্ত সবচেয়ে বেশি গরু মারা গেছে খুলনায়। সেখানে এ পর্যন্ত ৬২টি গরু মারা গেছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামে ২২, ঢাকায় ৭, রাজশাহীতে ৩ ও বরিশালে ১টি গরু মারা গেছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে খামারিদের এই রোগ নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ হিসেবে গরুর খামার এলাকাটি মশা–মাছিমুক্ত রাখা এবং আশপাশের এলাকা পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে খামার পরিচ্ছন্ন রাখা ও অসুস্থ গরুকে সুস্থ গরুর পাশে না রাখার জন্য বলা হয়েছে। সম্ভব হলে আক্রান্ত গরুকে মশারির মধ্যে রাখতে হবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. আলিমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রোগটি গবাদিপশুর শরীর থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই। তবে অন্য প্রাণীর দেহে তা ছড়াচ্ছে কি না, তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। আর যেসব প্রাণী আক্রান্ত হয়েছে সেগুলোকে দ্রুত চিকিৎসা দিয়ে যেগুলো আক্রান্ত হয়নি, সেগুলোকে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।