‘নয় মাস ধরে বাড়ি যাই নাই। মা-বাপ রে ফোনে কইছিলাম, দেশে করোনা, বাড়ি যাওন যাবে না। যে বিল্ডিংয়ে কাম করি ওইখানেই থাকি। ভাবছিলাম, এহানেই ঈদ কাটাইয়া দিমু। কিন্তু সাহেবরা দারোয়ানরে কইয়া দিসে, আমাগো বিশ্বাস করন যায় না। ঈদে যেন দারোয়ান ছাড়া বিল্ডিংয়ে কেউ না থাকে।’ রাজধানীতে একটি ভবনে নির্মাণশ্রমিকের কাজ করা মিজানুর রহমান (২৭) বলছিলেন কথাগুলো।
আজ মঙ্গলবার সকাল ৮টায় রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে মিজানুর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শিমরাইল মোড়ে এসেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যাবেন বলে। তিনি বলেন, ‘বড়লোকেরা নিজেগো গাড়িতে কইরা বাড়ি যায়। আমরা রাস্তায় বেইজ্জত হই। সরকারের দরকার আছিল, আমাগো মতো গরিব লোকগো বাড়ি যাইতে দিয়া বড় লোকগো আটকাই দেয়ার। শহরে আমাগো থাকার জায়গা নাই। বড় লোকগো আছে।’
মিজানুর দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করেও কম ভাড়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কোনো পরিবহন পাননি। বাধ্য হয়ে ট্রাকে ওঠার চেষ্টা করে তাতেও ব্যর্থ হয়েছেন। এরই মধ্যে বৃষ্টি শুরু হলে আশ্রয় নেন সড়কের পাশের একটি পরিত্যক্ত টিকিট কাউন্টারে। সেখানেই কথা হয় মিজানুরের সঙ্গে। ভাঙা চোয়াল, উষ্কখুষ্ক চুল, রোদে পোড়া শরীর, কাঁধে ঝোলানো ফাটাছেঁড়া ব্যাগ ধরে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলেন মিজানুর। সড়ক তখন বৃষ্টি উপেক্ষা করে ছুটে চলা ব্যক্তিগত গাড়ি আর ট্রাকের দখলে। দু-একজন যাত্রী তখনো কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন মাঝসড়কে। গন্তব্যে ছোটার একটা ব্যবস্থা যদি হয়।
সাত বছর ধরে ঢাকায় নির্মাণশ্রমিকের কাজ করেন মিজানুর। সারা বছর কাজে ব্যস্ত থাকলেও বছরের দুই ঈদ বাবা-মায়ের সঙ্গে উদ্যাপন করেন। এ বছর লকডাউনে সড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকা আর মানুষের ভোগান্তির কথা শুনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাড়ি ফিরবেন না। বাবা-মাকে রাজিও করেছিলেন। কিন্তু ভবনমালিক বলে দিয়েছেন, ‘কামের জাগায় থাকন যাইব না, বাড়ি যাও।’ শিমরাইল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যেতে মঙ্গলবার পরিবহনভেদে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা ভাড়া গুনতে হয়েছে যাত্রীদের। এত ভাড়ায় বাড়ি গিয়ে পোষাবে না। সকাল ১০টায় মিজানুর অপেক্ষায় ছিলেন কম ভাড়ায় কোনো ট্রাকে যদি চড়ে বসা যায়।
মিজানুরের মতো কয়েক হাজার মানুষ মঙ্গলবার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড, শিমরাইল মোড়, কাঁচপুর এলাকা থেকে বাড়ি ফিরেছেন। অন্যান্য দিনের তুলনায় মঙ্গলবার আরও বেশি ভাড়া ও ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে যাত্রীদের। সকালে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চলাচল করা দূরপাল্লার বাসগুলোতে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে তিন-চার গুণ বেশি ভাড়া গুনেছেন যাত্রীরা। বেশি ভাড়া নেওয়ার কারণ হিসেবে পরিবহনসংকট ও পথে পথে শ্রমিক সংগঠন এবং পুলিশের চাঁদাবাজির কথা বলছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা।
সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সাইনবোর্ড মোড়, শিমরাইল মোড় ও কাঁচপুর সেতুর পূর্ব পাশ থেকে ভাড়ায় চালিত মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেলের পাশাপাশি বাস, মিনিবাস, ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে করে যাত্রীরা গন্তব্যে রওনা হয়েছেন। এসব এলাকায় সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত রয়েল কোচ, শুভযাত্রা পরিবহন, শাহ সুন্দর পরিবহন, মনোহরদী পরিবহন, লিজা মারিয়া পরিবহন, নাফ পরিবহন, অনি পরিবহন, গজারিয়া পরিবহন, আঁচল পরিবহন, প্রিন্স পরিবহনসহ অন্তত ১৮টি পরিবহনকে যাত্রী নিতে দেখা গেছে। চট্টগ্রাম ও সিলেট সড়কে চলা বাসগুলো এলাকাভেদে জনপ্রতি ২০০ থেকে ১ হাজার ২০০ এবং মাইক্রোবাসগুলো ৬০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা ভাড়া নিয়েছে। গতকাল সোমবার এসব বাসে গন্তব্যে যেতে ১৫০ থেকে ৮০০ টাকা এবং মাইক্রোবাসগুলোতে ৪০০ থেকে ১ হাজার টাকা ভাড়া গুনতে হয়েছিল যাত্রীদের।
অন্যান্য দিনের তুলনায় মঙ্গলবার সকালে মহাসড়কে যাত্রীদের চাপও বেশি ছিল। এসব যাত্রীর সিংহভাগই নিম্ন আয়ের মানুষ। তবে দুপুর পর্যন্ত বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সড়কে যাত্রীর চাপ কমতে দেখা গেছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে সড়কে ভাড়ায় চালিত মাইক্রোবাস তুলনামূলক কম দেখা গেছে। অন্যান্য দিনের তুলনায় এসব এলাকায় পুলিশের উপস্থিতি বেশি ছিল। সড়কে পুলিশ থাকায় মাইক্রোবাসগুলোকে মূল সড়কের বদলে সড়কের পাশের পাড়া-মহল্লাগুলোতে দাঁড়িয়ে থেকে যাত্রী বোঝাই করতে দেখা গেছে। মঙ্গলবার পরিবহন না পেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে সড়কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে যাত্রীদের।
দীর্ঘ সময় ধরে সড়কে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের একজন পোশাককর্মী আকলিমা বেগম (৩২)। যাত্রীর চাপ বাড়ার আগেই বাড়ি ফেরার আশায় মঙ্গলবার ভোর পাঁচটায় চল্লিশ দিনের শিশুসন্তান ইমাম হোসেন ও শারীরিক প্রতিবন্ধী ছেলে ইমাম হাসানকে নিয়ে এসেছিলেন সাইনবোর্ড মোড়ে। সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত তিনি কোনো পরিবহন না পেয়ে সড়কেই সন্তানদের নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। আকলিমা বলেন, স্বামী–সন্তানদের নিয়ে সাভারে থাকেন তিনি। নরসুন্দরের কাজ করা স্বামী এখনই বাড়ি যেতে পারবেন না। সন্তানদের নিয়ে তাই নিজেই রওনা হয়েছেন। ভোগান্তি কমাতে সোমবার রাতে সাভার থেকে নারায়ণগঞ্জ বোনের বাড়িতে এসে রাত কাটিয়েছিলেন। সকাল থেকেই পরিবহনসংকট, দু-একটা পরিবহন পাওয়া গেলেও কুমিল্লা পর্যন্ত জনপ্রতি ভাড়া গুনতে হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। এত টাকা সঙ্গে না থাকায় ৪০০ টাকা ভাড়ায় পিকআপ ভ্যানে চড়তে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত মেঘলা আবহাওয়ায় শিশুসন্তানকে নিয়ে পিকআপে বসার সাহস হয়নি।
সকাল সাড়ে ১০টায় কাঁচপুর সেতু এলাকায় কথা হয় বেসরকারি হাসপাতালের গাড়িচালক আবু হানিফের সঙ্গে। ঢাকার মালিবাগ থেকে এসেছেন ভোলা যাওয়ার উদ্দেশে। অন্যান্য বছর সদরঘাট থেকে লঞ্চে করে ভোলায় চলে যান। এ বছর হিসাব করে দেখেছেন, ভেঙে ভেঙে বাড়ি যেতে অন্তত নয়বার যানবাহন পাল্টাতে হবে তাঁর। এত ভোগান্তি নিয়ে বাড়ি যাওয়ার প্রয়োজন কী? এমন প্রশ্নে আবু হানিফের উত্তর, ‘সাত বছরের ছেলেটা বারবার ফোন করে জিজ্ঞেস করে, লাল চশমা লইয়া বাড়ি আইবা কবে বাবা?’