লাশ দাফন, সৎকার করছেন তাঁরা

চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলায় করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশ দাফনের জন্য কবরস্থানে নিয়ে যাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। সম্প্রতি উপজেলার নাউজান গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলায় করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশ দাফনের জন্য কবরস্থানে নিয়ে যাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। সম্প্রতি উপজেলার নাউজান গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

ঝড়-বৃষ্টির রাত। বিদ্যুৎ নেই, অন্ধকার। তাঁরা খবর পেলেন, করোনার উপসর্গ নিয়ে গ্রামের এক ব্যক্তি মারা গেছেন। প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে ছুটে গেলেন আট স্বেচ্ছাসেবী। গিয়ে দেখেন, বাড়ির উঠানে লাশ। অদূরে মানুষের জটলা। মৃত ব্যক্তির পরিবারকে সমবেদনা জানানো এবং দাফনে অংশ নিতে এ রকম জটলা স্বাভাবিক বিষয়। তবে করোনা সব পাল্টে দিয়েছে। জড়ো হওয়া গ্রামবাসী তাঁদের সদ্য মৃত প্রতিবেশীকে ওই গ্রামে দাফন করতে দেবেন না। সে দাবিতেই এত ভিড়।

গত ২৭ মে রাতে চাঁদপুর মতলব দক্ষিণ উপজেলার নাউজান গ্রামে করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত এক ব্যক্তির লাশ দাফন করতে গিয়ে এ রকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় সিফাত উল্লাহ মজুমদার ও তাঁর দলকে। এই করোনাকালের গত দুই মাসে দয়া-মায়াহীনতার এমন দৃশ্য দেখে অনেকটা অভ্যস্ত সিফাত ও তাঁর দল। চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলায় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আহ্বায়ক সিফাত। নয়জনের এই দলটি গত দুই মাসে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এবং করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ৪০ জনের মৃতদেহ দাফন ও একজনের দেহ সৎকার করেছে। তাদের একজন সদস্য রফিকুল ইসলাম (৪০) গত মাসে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারাও যান। তবু দলটি এই কাজ থেকে সরে আসেনি। এই দলের বাকি সাতজন হলেন মো. জিসান, মনিরুজ্জামান, ইসহাক আলী, মো. হুমায়ুন, মো. আশিক, ইরাম ও আবদুর রশিদ। তাঁদের বাড়ি উপজেলা সদর ও আশপাশের এলাকায়।

নাউজান গ্রামের সেই রাতের অভিজ্ঞতা জানিয়ে সিফাত বলেন, গ্রামবাসীর প্রতিরোধের মুখে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, যেকোনো কৌশলেই হোক লাশ দাফন করতেই হবে। তাঁরা লাশ নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। নির্জন একটি জায়গায় গোসল সম্পন্ন করেন। এরপর এলাকাবাসীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে লাশ নিয়ে কাদা-পানির দেড় কিলোমিটার পথ হেঁটে রাত সাড়ে তিনটার দিকে দূরের একটি কবরস্থানে দাফন করেন। যখন বাসায় ফেরেন, তখন ভোর পাঁচটা।

স্বেচ্ছাসেবীরা জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মেনে ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই), মাস্ক ও গ্লাভস পরেই তাঁরা দাফন ও সৎকারের কাজ করছেন। তবু রফিকুল করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। প্রথম দিকে সবার ভয় লাগলেও এখন ভয়-সংকোচ কিছুই হয় না।

সিফাত উল্লাহ বলেন, এসব লাশের কাছেও আসতে চান না কেউ। পরিবারের লোকেরাও দূরে থাকেন। এসব অমানবিকতা দেখে তাঁরা মন থেকেই এ কাজ করতে নেমেছেন। বাধার কারণে অধিকাংশ দাফনই হয়েছে রাতের বেলায়।

দলের সদস্য মো. ইসহাক বলেন, প্রায় প্রতিটা দাফনেই মানুষের বাধা এসেছে। অনেক জায়গায় এলাকাবাসীর গালাগাল শুনতে হয়েছে।

মতলব দক্ষিণের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাহমিদা হক বলেন, তাঁরা যেভাবে জীবন বাজি রেখে দাফন-সৎকার করছেন, তা সত্যিই অনন্য। তাঁরা সত্যিকারের করোনাযোদ্ধা।