শত বছরের পুঁথিতে উইপোকা

দিনাজপুর শহরের নিমতলায় সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়ের জরাজীর্ণ ভবন
ছবি: প্রথম আলো

আলমারির তাকে বাঁশপাতায় লেখা প্রাচীন পুঁথি। কাঠের মলাটে আবদ্ধ হয়ে পাটের সুতলিতে বাঁধা পড়ে আছে। মলাটের ওপরে ধুলার স্তূপ। পাশে রাখা আছে মহাভারত, জগদীশ চন্দ্র ঘোষ সম্পাদিত গীতাসহ অসংখ্য প্রাচীন পুস্তক। পুঁথির মলাট উল্টে বিবর্ণ সংস্কৃত কিছু শব্দ পড়া গেলেও বেশির ভাগ পুস্তকে হাত রাখলেই চুপসে যায় হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো। আলমারির প্রতিটি তাক দখলে নিয়েছে উইপোকার দল।

এটা দিনাজপুর শহরের নিমতলায় সংস্কৃত মহাবিদ্যালয় পাঠাগার। শহরের নিমকালীমন্দিরের পাশে দাঁড়ালেই চোখে পড়বে কালো সাইনবোর্ডে সাদা অক্ষরে লেখা দিনাজপুর সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৭০। তার নিচেই লেখা ‘নিত্য ধর্ম্ম বোধিনী সভা’, প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৬০। প্রতিষ্ঠানটির বয়স দেড় শ বছরের অধিক। স্থানীয় লোকজনের কাছে পরিচিত টোল বা চতুষ্পাঠী হিসেবে।

নিত্য ধর্ম্ম বোধিনী সভা কিংবা সংস্কৃত মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সাল পাওয়া গেলেও এর লিখিত কোনো ইতিহাস পাওয়া যায় না। সংরক্ষিত নেই নথিপত্র। থাকলেও খেয়ে গেছে উইয়ের দল।

সম্প্রতি সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়ে গেলে দেখা মেলে টিনের ছাউনিতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা ইট ও মাটির তৈরি চৌয়ারী আকৃতির হলুদ রঙের একটি ভবন। ভবনটিতে ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করছে বারান্দায় চৌকোনাকৃতির দুটি পিলার। দেয়াল থেকে খসে পড়ছে মাটি।

জানা যায়, দিনাজপুর শহরের নিমতলায় সনাতনপন্থী হিন্দুরা ধর্মীয় জ্ঞানচর্চাবিষয়ক সাপ্তাহিক সমাবেশ করতেন। সেটি নিত্য ধর্ম্ম বোধিনী সভা নামেই পরিচিত। ধীরে ধীরে এই টোল হিন্দুধর্মের বিভিন্ন শাস্ত্র বিষয়ে শিক্ষাদানের এক বিরাট কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। ১৯০১-০২ সালে সরকার কর্তৃক অনুমোদনপ্রাপ্ত হয়ে নাম ধারণ করে দিনাজপুর সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়।

সম্প্রতি সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়ে গেলে দেখা মেলে টিনের ছাউনিতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা ইট ও মাটির তৈরি চৌয়ারী আকৃতির হলুদ রঙের একটি ভবন। ভবনটিতে ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করছে বারান্দায় চৌকোনাকৃতির দুটি পিলার। দেয়াল থেকে খসে পড়ছে মাটি। টিনের চালে ধরেছে জং, হয়েছে ফুটো। কয়েকটি আলমারির ভেতরে উইপোকাসহ বইয়ের খোলস। জরাজীর্ণ ভবনের উভয় পাশে ছোট ছোট কয়েকটি কামরা। এখানে আবাসিক শিক্ষার্থী আছেন সাতজন।

সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়ের প্রথম আচার্য হিসেবে পাওয়া যায় পণ্ডিত অমরচন্দ্র ভট্টাচার্যের নাম। তৎকালীন মহরাজা গিরিজানাথ এই টোল প্রতিষ্ঠার পর বিক্রমপুর থেকে নিয়ে আসেন তাঁকে। পরবর্তী সময়ে বংশানুক্রমে তাঁর পুত্র গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য, এরপর নাতি শেখর চন্দ্র ভট্টাচার্য এবং সর্বশেষ দায়িত্ব পালন করছেন প্রপৌত্রী ইলা ভট্টাচার্য।

টোলের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল প্রাচীন গ্রিসে সক্রেটিসের গুরুশিষ্য পদ্ধতির মতো। শিক্ষার্থীরা এখানে আবাসিকে থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন। শিক্ষার্থীরা অষ্টম শ্রেণির পরে এখানে কাব্য, স্মৃতি, জ্যোতিষ, পৌরোহিত, দর্শন, বেদান্ত, সাংখ্য ও পুরানতীর্থ অধ্যয়ন করেন। তিন বছর পড়া শেষে সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ড থেকে পাসের সনদ দেওয়া হয়। এখনো সেই ধারা টিকে আছে। তবে এখন এসএসসি পাসের পর ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি করানো হয়।

একসময় তিন শতাধিক শিক্ষার্থী শিক্ষা গ্রহণ করলেও বর্তমানে কাগজে-কলমে শিক্ষার্থী আছেন শতাধিক। এখন টোলে কোনো ক্লাস হয় না। নেই কোনো টেক্সট বই। টোলের আবাসিক শিক্ষার্থী দিনাজপুর সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী পলাশ চন্দ্র বলেন, ‘হিন্দুধর্মের শিক্ষক হতে হলে কাব্য আদ্য, কাব্য মধ্য, কাব্য ‍উপাধি পাস করে নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। তাই এখানে ভর্তি হয়েছি।’

অধ্যক্ষ ইলা ভট্টাচার্য বলেন, ‘বংশানুক্রমে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আমরা পরিচালনা করে আসছি। একজন শিক্ষক ভাতা পান বছরে ২ হাজার ১০২ টাকা। আর একজন পিয়ন পান ১ হাজার ৮৮ টাকা।

বাংলাদেশ সংস্কৃত ও পালি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোপেশ চন্দ্র বলেন, ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষাব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে গত ৪০ বছরে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অথচ একটা সময় প্রতিটি স্কুলে পণ্ডিত শিক্ষক ছিল। বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণে তাঁরা ছিলেন বিশেষভাবে দক্ষ। ১৯৮০ সালের দিকে পণ্ডিত পদটিকে বিলুপ্ত করা হয়। ২০০১ সালে শর্ত সাপেক্ষে তা আবারও চালু করা হয়। তাঁর মতে, এভাবে চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী এই সংস্কৃত ও ধর্মচর্চা প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সুতরাং পালি ও সংস্কৃত শিক্ষা বোর্ডকে স্বায়ত্তশাসনের মধ্যে এনে শিক্ষকদের সম্মানী ভাতা বৃদ্ধি করা, কলেজ ভবন নির্মাণ এবং আদ্য, মধ্য ও উপাধি পাস করাকে বিশেষ মর্যাদার আওতায় আনা এখন সময়ের দাবি।